করোনা সংক্রমণ

প্রকোপ কম, তবুও উদ্বেগ

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ১১: ৩৬
ফাইল ছবি

দুই বছর ধরে স্থিতিশীল দেশের করোনা পরিস্থিতি। সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারতসহ কয়েকটি দেশে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশেও পুরোনো একটি ধরনের নতুন উপধরন শনাক্ত হয়, যা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দেয়। এর বিস্তার ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়, প্রস্তুতি নিতে বলা হয় হাসপাতালগুলোকে।

গত এক সপ্তাহে করোনা সংক্রমণে সারা দেশে ১২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যান পাঁচজন। তবে করোনা বাড়লেও আগের মতো ব্যাপকভাবে ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মাঠপর্যায়ে হাসপাতালগুলোর পরীক্ষা কেন্দ্র ঘুরেও এমন তথ্য মিলেছে।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে দেখা গেছে, সাধারণ জ্বর হলেও করোনা ধরে নিয়ে পরীক্ষা করাতে আসছেন মানুষ। কিন্তু পরীক্ষায় ভাইরাসটির উপস্থিতি তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলোয়ও করোনায় আক্রান্ত তেমন রোগী পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মাসে তিন হাজার ১৮১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়, যেখানে শতকরা হার ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মাসের শুরুতে সংক্রমণের হার কিছুটা নিম্নগামী হলেও গত এক সপ্তাহে তা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।

তথ্য বলছে, প্রথম সপ্তাহে সংক্রমণের হার প্রায় ৩ শতাংশ হলেও গত এক সপ্তাহে তা ৭ শতাংশে উঠেছে। ১৫ জুন থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত দুই হাজার ৬০ জনকে পরীক্ষা করা হলে ১৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মারা গেছেন ১২ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি আগের মতো ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। তবে মাঝে মাঝে বাড়তে পারে। এজন্য মৌসুমি জ্বর, সর্দি ও বক্ষব্যাধির রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণ জ্বরেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে সাধারণ জ্বর, সর্দি, গলাব্যাথাসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিনই শতাধিক রোগী আসছেন। চিকিৎসকরা শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত সন্দেহ হলে পাশেই নমুনা সংগ্রহের বুথে পাঠাচ্ছেন। দুটি বুথে দৈনিক ১৫ থেকে ২৫টি র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। তবে নতুন করে কোভিড পরীক্ষা শুরুর পর এখন পর্যন্ত একজনও আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়নি হাসপাতালটিতে।

গতকাল রোববার ফ্লু কর্নারে রোগীদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। এ সময় কথা হয় মিরপুরের আবু হেনার (৩৪) সঙ্গে। বেসরকারি একটি কোম্পানিতে কর্মরত এই ব্যক্তি চারদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। শুরুতে ডেঙ্গু সন্দেহ করলে পরীক্ষায় তা নেগেটিভ এলে করোনায় আক্রান্ত ধরে নিয়ে এ চিকিৎসা কেন্দ্রে আসেন।

আমার দেশকে আবু হেনা বলেন, ‘জ্বর কখনো আসে, কখনো চলে যায়। গত মাসের শুরুতে একজন সহকর্মীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সবার মাঝেই এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে যে, আবারও করোনা এলো কি না। এজন্যই করোনা পরীক্ষা করাতে এসেছি।’

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্যাথলোজি বিভাগের তথ্যমতে, গত ২১ মার্চ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা পাওয়া গেছে মাত্র একজনের। এসব পরীক্ষা হয়েছে অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে। তবে হাসপাতালটিতে এখনো আরটি-পিসিআর চালু হয়নি।

প্যাথলোজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান ডা. শামীম আরা কেয়া আমার দেশকে বলেন, ‘বর্তমানে যারা উপসর্গ নিয়ে আসছেন, তাদের অ্যান্টিজেন কিটে শনাক্ত করা হচ্ছে। সব রোগীর পরীক্ষা করা হচ্ছে না। ফ্লু কর্নারের মেডিসিন চিকিৎসক ঠিক করেন কারো করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন আছে কি না।’

আরটি-পিসিআর চালু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর থেকে আরটি-পিসিআর যন্ত্রটি বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন পর চালু করতে হলে যন্ত্রটির গুণগতমান দেখতে হয়। বর্তমানে হাসপাতালের রি-এজেন্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ) দিয়ে পরীক্ষা চলছে। সেটি সম্পন্ন হলেই করোনা পরীক্ষা শুরু হবে।’

একই অবস্থা মহাখালীর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) হাসপাতালে। এক সময় হাসপাতালটি করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড করা হলেও বর্তমানে সেখানে ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এ হাসপাতালেও কোভিড পরীক্ষা আগের চেয়ে বেড়েছে। বর্তমানে দৈনিক ৩৫ থেকে ৫০টি পর্যন্ত পরীক্ষা হচ্ছে। এখানেও আক্রান্ত রোগী কম পাওয়া যাচ্ছে। গত শনিবার ৩৬ জনের পরীক্ষা করে মাত্র দুজনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি মেলে।

ডিএনসিসি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডা. আসিফ হায়দার আমার দেশকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল রয়েছে। যেহেতু এটি রেফার হাসপাতাল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে রোগী আসে। কিন্তু অবস্থা এখনো এমন পর্যায়ে যায়নি যে, শয্যা দেওয়া যাচ্ছে না। গত মাসে ভর্তি হয়েছিল ছয়জন, চলতি মাসে ধীরে ধীরে বাড়লেও সেটি ২০ জনের উপরে যায়নি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কমে গেছে। হয়তো আগের মতো ভয়ংকর হবে না। তবে সতর্ক থাকা দরকার। হাসপাতালগুলোয় শ্বাসতন্ত্রের রোগী বৃদ্ধি পেতে পারে, এজন্য প্রস্তুতি থাকা দরকার। মনে রাখা দরকার, ভাইরাস বেশি বেশি ছড়ালে মরণাত্মক ক্ষমতা পায়। ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জাও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর জন্য খারাপ।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘কোভিড নিয়ে উদ্বেগ ঠিকই আছে। মানুষ যে পরীক্ষা করতে আসছে, এটা ভালো দিক। তার মানে মানুষের মাঝে যে সচেতনতা এসেছে, এটা খুব দরকার। তবে এখন পর্যন্ত আমরা আতঙ্কিত বলিনি। আমরা বলেছি উদ্বেগ আছে।’

তিনি বলেন, ‘পরীক্ষায় পজিটিভি না পাওয়া মানে করোনা নেই বলা যাবে না। যে অ্যান্টিজেন দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা নতুন ধরন শনাক্তের সক্ষমতা রাখে কি না তা দেখতে হবে। একই কথা আরটি-পিসিআরের বেলায়ও। যে ট্রাইমার দিয়ে শনাক্ত করা হয়, সেটি আগের ভেরিয়েন্টের (ধরন) ওপর নির্ভর করে তৈরি হরা হয়েছিল, নতুন ধরনের জন্য নতুন ট্রাইমার দরকার।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত