আওয়ামী শাসনামল

আলোর মুখ দেখেনি সিলেটের কোনো মেগা প্রকল্প

খালেদ আহমদ, সিলেট ব্যুরো
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০২: ২৫

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, খনিজসম্পদে ভরপুর ও প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট দেশের রাজস্ব খাতে অনন্য ভূমিকা রাখলেও উন্নয়নের দিক দিয়ে রয়েছে পিছিয়ে। গত ১৭ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার এ অঞ্চলে বাস্তবায়ন হয়নি কোনো মেগা প্রকল্প।

সিলেটের বিপুলসংখ্যক অধিবাসী প্রবাসী। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, সিলেট-ঢাকা ছয় লেন হাইওয়ে নির্মাণ, সিলেট-ঢাকা রেলের ডাবল লাইন, বিমানবন্দর সড়ক চার লেন ও বাদাঘাট-বিমানবন্দর-বাইপাস সড়কসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পই ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হয়নি।

বিজ্ঞাপন

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গত এক বছরে সিলেটের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। বিগত সরকারের আমলে গৃহীত কয়েকটি প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই, কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাতিলও করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে ১১টি একনেক সভায় ১১৬টি প্রকল্পের অনুমোদন হলেও এতে সিলেটের উন্নয়নে কোনো প্রকল্প নেই। এসব প্রকল্পে মোট এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সম্প্রতি নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও সব ক্ষেত্রে সিলেটের সঙ্গে বৈষম্য করছে।

তিনি বলেন, অনেক উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সিলেটের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দ্রুত ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি পাস করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।

সাবেক মেয়র অভিযোগ করেন, ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনের প্রকল্পটি বেশ প্রশংসিত হচ্ছিল। কিন্তু পরে তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ বাইপাস সড়কের বিমানবন্দর থেকে বাদাঘাট পর্যন্ত এখনো কাজ হয়নি। ঢাকা-সিলেট ছয় লেন মহাসড়কের ভূমি অধিগ্রহণ এখনো শেষ হয়নি। দুর্ভোগ লাঘবে সিলেট-ঢাকা হাইওয়ে নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে- তা জানতে চাই।

অভিযোগ রয়েছে, এ অঞ্চলের গ্যাস দিয়ে দেশের অন্যত্র শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলেও খোদ সিলেটে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও গড়ে ওঠেনি শিল্প-কারখানা। পর্যটনশিল্প অর্থনীতির উদীয়মান খাত হলেও সিলেটে পর্যটনশিল্প বিকাশে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেয়নি কোনো সরকার।

২৭টি ওয়ার্ড থেকে ৪২টি ওয়ার্ডে উন্নীত করা হলেও বিশাল এই এলাকার জন্য নেওয়া হচ্ছে না কোনো উন্নয়ন প্রকল্প। রাস্তাঘাট, ড্রেন ও পানি সরবরাহের কোনো সুবিধা এখনো এসব এলাকার জনগণ পাচ্ছে না।

সম্প্রতি দেশের অন্যতম পর্যটন স্পট জাফলং পরিদর্শনে এসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পর্যটন স্পটগুলোর বালু-পাথরকোয়ারি সরকার আর লিজ দেবে না। পর্যটনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সিলেটের সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকার উন্নয়ন করা হবে।

এ সময় উপস্থিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সিলেটের পর্যটন এলাকার উন্নয়ন করা হলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রবাসী রেমিট্যান্সের চেয়েও বেশি আয় হবে এখান থেকে। সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো এখন পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

বিছনাকান্দি গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, দিনে দিনে পর্যটকদের সংখ্যা ও আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়নি উন্নত সড়ক।

আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট গোলাম সাদাত জুয়েল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এই দুই উপদেষ্টার মতো বিগত দিনেও অনেক মন্ত্রী-এমপি নানা স্বপ্ন দেখিয়েছেন; কিন্তু সিলেটবাসীর প্রকৃত উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো প্রকল্প গৃহীত হয়নি।

সিলেটবাসীর সবচেয়ে বড় দুঃখ আর কষ্টের কাহিনি সিলেট-ঢাকা ছয় লেন মহাসড়ক। বিগত ১৭ বছর আশ্বাসের পর আশ্বাস দেওয়া হলেও এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের কিছু এলাকা ভাঙা-গড়ার কারণে সিলেট থেকে ঢাকা যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে।

এদিকে ট্রেনলাইনের অবস্থাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেললাইন সংস্কারে নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। গত ১৭ বছরে দেশের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু সিলেট রয়ে গেছে অন্ধকারেই।

প্রবাসীদের দাবির প্রেক্ষিতে ‘আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামকরণ করা হলেও নেই আন্তর্জাতিক কোনো সুবিধা। বিদেশের কোনো ফ্লাইট ওসমানী বিমানবন্দর পরিচালনা করতে পারছে না। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর দুই হাজার ৩০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে পাস হয়। প্রকল্পটির তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ৭ বছরে তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পরও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ১১ মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মোট ১১টি সভা করেছে। এসব সভায় সারা দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়েছে।

এই উন্নয়ন বরাদ্দের অর্ধেকই ব্যয় হবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের জন্য। তবে এককভাবে সিলেটের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প পাস হয়নি এ সরকারের আমলে।

সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী আমার দেশকে জানিয়েছেন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প (সংশোধিত) ও সিলেট সিটি করপোরেশনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, পানি শোধনাগার প্রকল্পসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এসব প্রকল্পের ফাইল মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনেই পড়ে আছে, একটি প্রকল্পও আলোর মুখ দেখেনি।

জানা যায়, গত জুন মাসের একনেক সভায় অনুমোদিত ৭টি বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যার মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের একটি নির্মিত হবে বিভাগীয় শহর সিলেটে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে সিলেটের ১২নং কূপ খনন (তেল কূপ) একটি প্রকল্প পাস হয়। এই দুটি প্রকল্পের বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়নি।

আর ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯৯.৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট বিভাগে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৈলাশটিলা-৯ কূপ (অন্বেষণ কূপ) অনুসন্ধান প্রকল্প পাস হয়। এর বাইরে সিলেট বিভাগের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়নি সরকার। একনেকে পাস হওয়া ১১৬ প্রকল্পের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের তিনটি প্রকল্প রয়েছে। সিলেটের কোনো মেগা প্রকল্প একনেকে পাস হয়নি।

সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ২০০১-০৬ সালের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময়ে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, সিলেট-১ আসনের এমপি মরহুম সাইফুর রহমানের হাত ধরে সিলেটে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সিলেট বৈষম্যের শিকার- এটা মেনে নেওয়া যায় না।

গত ১৮ বছর ধরেই সিলেটকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে সিলেট বিভাগের পরিকল্পনামন্ত্রী থাকলেও তার নিজ এলাকা ছাড়া কোথাও উন্নয়ন হয়নি।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সিলেটের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি নিয়ে আমরা হতাশ। বিগত সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও ১১টি একনেক মিটিংয়ে সিলেটের বড় কোনো প্রকল্প অনুমোদন হয়নি। এটা সিলেটবাসীর জন্য দুঃখজনক।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত