তনু হত্যার ৯ বছর আজ

দু’জনের দিকে সন্দেহের তির পরিবারের

পীর জুবায়ের
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৫, ১০: ১৩

আজ ২০ মার্চ। ২০১৬ সালের এইদিনে খুন হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। এই হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পেরিয়ে ১০-এ পা দিলে এখনো বিচারের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে পরিবার। ৯ বছর আগে এমন এক সন্ধ্যায় বাসা থেকে প্রাইভেট পড়াতে বের হন তনু। কিন্তু ফেরেন লাশ হয়ে। দীর্ঘ এ সময় কত সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, তারপর দিন নামে, কিন্তু তনুর আর ঘরে ফেরা হয় না। এখনো তার জন্য অজানা এক প্রতীক্ষায় দিন কাটে মা আনোয়ারা বেগমের।

সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনায় তখন দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে বিচারের দাবি। দেশ-বিদেশে নানা আলোচনা-সমালোচনার সঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা হলেও এখনো এ বিচারপ্রক্রিয়া আলোর পথ দেখেনি। আজও বিচারের আক্ষেপ নিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে তনুর পরিবারকে।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার ৯ বছর পার হলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না তনুর পরিবার। প্রায় সাতদিনের চেষ্টায় তনুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমার দেশের এই প্রতিবেদকের। কথা বলার আগে অজানা একটি ভয় তাদের কথার মধ্যে ফুটে ওঠে। বারবার প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইছেন আসলেই তারা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন কি না। সন্দেহ কিছুটা কমলে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘৯ বছর ধরে অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছি। জীবদ্দশায় আমার মেয়ের বিচার দেখার ভাগ্য আমার হবে না। একটি মাত্র মেয়ে ছিল আমার।’ এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলছিলাম আমার মেয়েকে। তিন সন্তানের মধ্যে তনু ছিল একমাত্র মেয়ে। অভাবের সংসার, কিন্তু তনুকে অভাব বুঝতে দিইনি। সুস্থ অবস্থায় আমার মেয়েটা বের হয়ে যায়, ফিরল নিথর হয়ে। এর থেকে কষ্ট-যন্ত্রণা একটা মায়ের আর কী হতে পারে।’

মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে আনোয়ারা বেগম বলেন, মামলাটা কী অবস্থায় আছে জানি না। কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। ৯ বছর হয়ে গেছে। মামলা তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) কখন বদলে যায়, কখন কী করেÑ তা আমরা কিছুই জানি না। আগে ছিল মুজিবুর নামের একজন, এখন নাকি নতুন আইও তরিকুল। তাকে আমি ফোন দিয়েছিলাম, কিছু বলেননি মামলা সম্পর্কে।’

তনু হত্যায় সন্দেহভাজদের বিষয়ে আনোয়ারা বলেন, ‘আমরা সবাইকে দোষ দিচ্ছি না। যে দু’জন প্রধান সন্দেহভাজন, তাদের নিরপেক্ষভাবে জিজ্ঞাসা করলে আমার মেয়ের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গে বিচার হবে।’ এ সময় তিনি বলেন, ‘৯ বছর যারা মামলার আইও ছিলেন তাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক। ওদেরও বিচার করতে হবে। যতগুলো আইও ছিল সবাই অভিযুক্ত ওই ব্যক্তিদের লোক। কেউ আমাদের সহায়তা করছে না। আমার যা বলার আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলব। আমরা পূর্ণ আশাবাদী তাকে সব বলার পর মেয়ের বিচার পাব।’

মামলার বিষয়ে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়ে তার (অভিযুক্ত ব্যক্তি) বাসায় পড়াতে গিয়েছিল। এরপর মেয়েটা আর ফেরত আসেনি। আমি যখন মেয়ের খোঁজে তার বাসায় যাই, তখন তিনি আমাকে কিছু বলেননি। এমনকি আজ পর্যন্ত তিনি বলেনি, আমার মেয়ের সঙ্গে কি হয়েছে, কোথায় গিয়েছিল।’

ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি বহুত বলছি তাকে আইনের আওতায় আনা হোক। তারে আইনের আওতায় আনা হয়নি এখনো। সে তো একটা মার্ডার মামলার আসামি। সঙ্গে তার স্ত্রীও যুক্ত। আমরা গণহারে দোষারোপ করছি না। ওই দু’জনকে ধরলেই সবকিছু পাওয়া যাবে।’

মামলায় কারো নাম থাকার বিষয়ে ইয়ার হোসেন বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসের ভেতরে থাকি। মামলা যদি আমি করতাম, তাহলে নাম উল্লেখ করে দিতাম। কিন্তু মামলা করছে আমার অফিস। কয়দিন পরপর আইও পাল্টায়। অথচ এটা পাল্টানোর কথা ছিল আমার। কিন্তু পাল্টায় তারা।’

সব কথা প্রকাশ করায় জীবনের হুমকি আছে জানিয়ে ইয়ার হোসেন বলেন, আমরা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চাই, যা বলার সেখানে বলব। তনুর মা হত্যাকারীদের ফাঁসি চায়Ñ নিউজের মধ্যে এটা বলবেন সবাইকে। আমাদের যেন ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। আমরা বড় অসহায় অবস্থায় আছি।’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে সোহাগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু নিয়মিত সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতেন। সেই বাসার আশপাশের জঙ্গলে তার লাশ পাওয়া যায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করে পুলিশ। লাশের দুই দফা ময়নাতদন্ত হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়। সে সময় তনুর জামা-কাপড় থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যায়।

তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জোরালো আন্দোলন করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। এ ঘটনায় যে মামলাটি হয় তার তদন্তের দায়িত্ব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো মামলার কূলকিনারা মেলেনি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত