এনসিপি ছাড়াই জুলাই সনদে সই

এম এ নোমান ও মাহফুজ সাদি
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৩১
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৩২

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। এতে দেশের প্রধান দলগুলো সাড়া দিলেও সই করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের পর এতে সই করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্য। যেসব দল গতকাল স্বাক্ষর করেনি, তারা চাইলে পরেও স্বাক্ষর করতে পারবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নবজন্ম হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হলো। পুরো জাতি এর থেকে নতুন পথের দিশা পাবে। যে ঐক্যের সুর আজ বেজে উঠেছে, তা নিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ইতিহাসের স্মরণীয় নির্বাচন করব।’

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে গতকাল জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় খোলা মঞ্চে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৃষ্টি ও কথিত জুলাইযোদ্ধাদের বিক্ষোভের কারণে অনুষ্ঠান কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বিকাল ৪টায় কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও আধঘণ্টার মতো দেরি হয়। বিকাল ৪টা ৩৭ মিনিটে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

এতে যোগ দিয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক। স্বাক্ষরমঞ্চে প্রধান উপদেষ্টাসহ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং অংশগ্রহণকারী ২৫ রাজনৈতিক দলের দুজন করে প্রতিনিধি বসেন। এছাড়া শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন ড. ইউনূস। তার সঙ্গে ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। অনুষ্ঠান শুরুর পর আলী রীয়াজ স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। প্রথমে রাজনৈতিক দলের নেতারা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন। এরপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও ড. ইউনূস সই করেন। স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এই সনদ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে বলে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া এতে স্বাক্ষর করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামুল বশির, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও মহাসচিব মোমিনুল আমিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও সিনিয়র সহসভাপতি তানিয়া রব, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, ১২ দলীয় জোটের প্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, জাকের পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ভুইয়া ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ, জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু), মহাসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল কাদের ও মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী এবং আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান সই করেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান উপস্থিত থাকলেও তারা সনদে সই করেননি। দলটি পরে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল এনসিপি ছাড়াও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। দলগুলো আগেই সংবাদ সম্মেলন করে জুলাই সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছিল। এসব দলের কোনো প্রতিনিধিও স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেননি।

আয়োজনে যা ছিল

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সুসজ্জিত বিশাল মঞ্চ। সামনে সারি সারি চেয়ার। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টির আলামত না থাকলেও দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। সঙ্গে দক্ষিণের হিমেল হাওয়াও বইছিল।

ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখতে কথিত জুলাইযোদ্ধাদের বিক্ষোভ প্রতিহত করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেন আয়োজকরা। বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সময়সূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে অনুষ্ঠান কিছুটা পেছানোর আগাম বার্তা দেওয়া হয়। তবে বেলা ৩টা থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন ফারুক এবং লুৎফুজ্জামান বাবরকে দেখা যায় সামনের সারিতে। একই সারিতে ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মো. শাহজাহান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট শিশির মনিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনীর প্রধান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরাও অনুষ্ঠানে অংশ নেন। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবার ও আহত জুলাইযোদ্ধারাও ছিলেন আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে।

আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন। অতিথিদের সারিতে ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার ও তার স্ত্রী তানসিম আরেফা সিদ্দিকী, বন ও পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী প্রমুখ।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা ছাড়াও অনুষ্ঠানে উচ্চ আদালতের বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রধানরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাস তুলে ধরে সাত মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এতে মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে ডকুমেন্টারিতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের গুম-খুন, মানবাধিকার লংঘন, অর্থ পাচার বর্ণনার পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো বর্বর হামলার চিত্র দেখানো হয়।

এদিকে বিভিন্ন দল সনদে সই করলেও আইনি ভিত্তি দাবিতে বিরত ছিল এনসিপি। সনদ স্বাক্ষরের আগে এক অনুষ্ঠানে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐকমত্যের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে একটি কাগজে (জুলাই সনদ স্বাক্ষর) সই করছে।

জুলাই সনদ দল ও রাষ্ট্রের মধ্যে

সামাজিক চুক্তি

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের মতের পার্থক্য থাকবে। রাজনীতিতে মতপার্থক্য না থাকলে তা গণতান্ত্রিক হয় না। মতের পার্থক্য থাকবে, পথের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু গণতন্ত্রের জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

তিনি বলেন, এই সনদ কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি নয়, এটা নাগরিকের সঙ্গে দল ও রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তি। তিনি আরো বলেন, যে জাতীয় দলিল তৈরি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ঘটবে। দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন ঘটবে। নাগরিকদের মতামতের মধ্য দিয়ে এই দিক দিশা নির্দেশক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে পরিচালনা করবে।

জুলাই যোদ্ধাদের বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

জুলাই সনদে জুলাই আন্দোলনে অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আইনি সুরক্ষা, পুনর্বাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে শতাধিক মানুষ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরুর আগে বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে তারা সংসদ ভবন এলাকার গেট টপকে ভেতরে ঢোকেন। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চের সামনে অবস্থান নেন। মঞ্চের সামনে নির্ধারিত অতিথিদের চেয়ারে বসে স্লোগান দিতে থাকেন। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় কয়েকজনকে লাঠিপেটা করতে দেখা যায়। মঞ্চ থেকে বেরিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় বিক্ষোভ করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। ইটপাটকেল নিক্ষেপ, বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুন জ্বলতেও দেখা যায়। সোয়া ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতেও তারা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং তাদের দাবি মানা না হলে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।

দাবির মুখে সনদ সংশোধন

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের আগে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফা সংশোধন করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল দুপুর ২টার দিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই সংশোধনের কথা জানানো হয়। দফাটিতে আগে ছিল, ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।’

সংশোধিত দফায় বলা হয়েছে, ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের মাধ্যমে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবার এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।’

সংশোধনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আন্দোলনরত জুলাই বীর যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে গতকালের আলোচনাসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই বীর যোদ্ধাদের দাবির প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় জরুরি সংশোধন করা হয়েছে। এ সময়ে তিনি সংশোধিত ভাষ্যটি পাঠ করেন।

তিনি বলেন, কমিশন এই অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের কোনো মতপার্থক্য নেই।

সনদে যা আছে

তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রায় আট মাস ধরে আলোচনা শেষে রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পর্কিত জুলাই সনদ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সমন্বয় করে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে এই জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আগে সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। সবার মতামত পর্যালোচনা করে এবং নির্ভুল আকারে জুলাই সনদ লিখিত আকারে চূড়ান্ত করে, গত ১৪ অক্টোবর সনদের চূড়ান্ত কপি সব দলকে দেওয়া হয়।

চূড়ান্ত সনদে বেশ কয়েকটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট’সহ ৮৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৭ দফা অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।

জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টির বাস্তবায়নে বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন করতে হবে। অপর ৩৭টি প্রস্তাব আইন-অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দলগুলোর মধ্যে মূলত সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ভিন্নমত আছে। গণভোটের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে গণভোট কখন হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো চায় আগামী সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলের দাবি সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা সনদের আইনি ভিত্তিও চেয়েছে।

জুলাই সনদে বেশকিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব আছে। সেগুলোর মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কিছুটা কমানো, কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো, এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন এবং এক ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না—এমন বিধান করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের বিধান করা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, আস্থাভোট ও অর্থবিল ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে আইনসভায় সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। অবশ্য এর মধ্যে বেশকিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের ভিন্নমত আছে। কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংস্কার প্রক্রিয়ার এক বছর

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে এই কমিশনগুলো তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর কমিশন প্রস্তাবগুলো নিয়ে এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। আলোচনার ভিত্তিতে মোট ৮৪টি প্রস্তাব (ভিন্নমতসহ) নিয়ে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করে ঐকমত্য কমিশন।

যা আছে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায়

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ৭ দফা অঙ্গীকার ও ঘোষণা করা হয়েছে জুলাই সনদে। সেগুলো হলো-

১. জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।

২. যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।

৩. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না, উপরন্তু উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব।

  1. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।

সংশোধিত ৫ম দফা, গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।

৬. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।

৭. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করবে।

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বহন করা সেই প্রিজন ভ্যানে কী আছে

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের নেয়া হয়েছে ক্যান্টনমেন্টের অস্থায়ী কারাগারে

গাজায় স্বাস্থ্য সংকট কয়েক প্রজন্ম থাকবে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

সেনা কর্মকর্তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল: আসামিপক্ষের আইনজীবী

দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান এরদোয়ানের

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত