এমসি কলেজে ধর্ষণ, চার বছরেও শুরু হয়নি বিচার কার্যক্রম

খালেদ আহমদ, সিলেট
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ৪৭

সিলেটের এমসি কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠে ছাত্রলীগের বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন এক নববধূ। কিন্তু নববধূকে বর্বর দলবদ্ধ ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কার্যক্রম চার বছরেও শুরু হয়নি। কেন বিচার কার্যক্রম এগোচ্ছে না তার আসল কারণ অনেকেই জানেন না। মূলত সরকার পক্ষের স্টের কারণে বিচারকার্যে কোনো অগ্রগতি নেই।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে এক যুবক তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে প্রাইভেট কারযোগে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে গেলে ছাত্রলীগের হায়েনাদের কবলে পেড়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন উক্ত নববধূ। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে জুলাই বিপ্লবের আগের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। ট্রাইব্যুনালে বদলি করতে হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে গত বছরের জুনে লিভ টু আপিল করে। আসামিদের রক্ষায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বর্বর ওই ঘটনায় মামলা দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল এক বছরেও কোনো সুরাহা হয়নি।

শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের ধর্ষক আসামিদের বাঁচাতে কৌশল করে তাদের গডফাদাররা। তৎপর হয়ে উঠেছিলেন পলাতক সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সিলেট জেলা ছাত্রলীগের পলাতক সভাপতি নাজমুল ইসলাম। বাদী অভিযোগ করেছেন তারা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং আপস করার বিষয়ে চাপ দিচ্ছিলেন বছরখানেক আগ থেকেই।

কাকতালীয়ভাবে তখনই নজিরবিহীনভাবে সরকারি উদ্যোগে লিভ টু আপিল করা হয়, যা করার কথা ছিল আসামিপক্ষের। এরপর থেকে মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে দুটি মামলার নথিপত্র সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই রয়েছে। গত চার বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় থাকা ঘটনাটি প্রভাবশালী মহলের অদৃশ্য কালো থাবায় পড়েছে।

দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এখন মামলার বাদী মাইদুল ইসলামও হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহী নন। টাকা নিয়ে আপসের বিষয়টি অপপ্রচার বলে তিনি দাবি করেন। জানান, মামলাটির কারণে বিভিন্ন হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। কিন্তু মামলার অগ্রগতি হয়নি।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বাদী পক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, অভিযোগ গঠনের পর থেকেই দুটি মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই। কার্যত মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম বন্ধ আছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটি পাঠানোর জন্য হাইকোর্ট আদেশ দেন। কিন্তু হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে আগের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে লিভ টু আপিল করা হয়।

জানা যায়, গত বছরের ২৬ জুন আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হরিপদ পাল স্বাক্ষরিত এক পত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরীকে লিভ টু আপিলের বিষয়ে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়। এক বছর পেরিয়ে গেলেও তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবীদের যথাযথ সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এক বছর আগে নোটিশ দিয়ে আমাদের লিভ টু আপিলের বিষয়ে জানানো হয়। কিন্তু এক বছরেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের কাছে এই মামলার বিচারের বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করি আমি।

বাদী পক্ষের অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলেও বিচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। আমরা বাদীর আইনজীবী হিসেবে দ্রুত এর ন্যায়বিচার চাই।

এর আগে ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ দলবদ্ধ ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মামলা দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর চূড়ান্ত আদেশ দেন। ওই আদেশে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট জারি করতেও বলা হলেও শুধু তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কারণে হাইকোর্টের ওই আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গেজেট জারি করলে বিচার কাজ শুরু হয়ে যেত।

ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে ফিরলেন নববধূ

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরের ২৪ বছর বয়সী এক যুবক তার ১৯ বছর বয়সী নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে দৃষ্টিনন্দন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান। ওই সময় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা স্বামী-স্ত্রীকে কলেজের ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে ছাত্রাবাসের ৭নং ব্লকের পঞ্চম তলা বিল্ডিংয়ের সামনে প্রাইভেট কারের মধ্যেই গৃহবধূকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষকরা দম্পতির সঙ্গে থাকা টাকা, স্বর্ণের চেন ও কানের দুল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আটকে রাখে তাদের প্রাইভেট কারও।

স্বামীকে ছেড়ে দিলে তিনি টিলাগড় পয়েন্টে গিয়ে পুলিশে ফোন দেন। পুলিশ আসতে বেশ সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ পেয়ে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ নির্যাতিতাকে ওসমানী হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। ওই রাতেই নির্যাতিতার স্বামী মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও তিন থেকে চারজনকে আসামি করে শাহপরান থানায় মামলা করেন।

গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ধর্ষণের সাজার আইনের পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল ২০২০ পাস হয়।

গ্যাংর‌্যাপে জড়িত ছিল ৮ জন

গ্যাংর‌্যাপে জড়িত ছিল আটজন। তারা হলো সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গির মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নং-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের ছেলে মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭)।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার আট ধর্ষকের সবাই ছাত্রলীগের টিলগড় গ্রুপের ও আওয়ামী গডফাদারদের অনুসারী। গ্রেপ্তারের পর আসামিরা অকপটে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

ঘটনার পরে গ্রেপ্তার আট আসামির প্রত্যেকের ডিএনএ নমুনা ওসমানীর ওসিসির মাধ্যমে সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ম্যাচিং পাওয়া যায়। এদিকে আইনুদ্দিন ও মিসবাহ উদ্দিন রাজনের ডিএনএ ‘মিক্সিং’ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

ডিএনএ রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ নিশ্চিত হয় এ ছয়জনই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছিল। গ্রেপ্তারের পর আদালত তাদের প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রিমান্ড শেষে আট আসামির সবাই জবানবন্দিতে গৃহবধূকে তুলে নেওয়াসহ দলবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। আসামিরা সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত