রকীবুল হক
মিরপুরে নিজের মাদরাসায় সকালে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী। পবিত্র রমজানের সেই সময়ে হঠাৎ সেখানে ডিবির একটি দল হানা দেয়। পরে ডিবি অফিসে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় তার কাছ থেকে।
একপর্যায়ে পুলিশ হত্যাচেষ্টার মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রথমে সাত দিন রিমান্ড এবং পরে জেলে পাঠানো হয় ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের এই সহ-প্রচার সম্পাদককে। এভাবে সাড়ে তিন মাস কাটাতে হয় জেলের অন্ধকারে।
মিরপুর তাহজিবুল উম্মাহ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী এসব তথ্য জানিয়ে আমার দেশকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের আলেম-ওলামাদের ওপর যে ধরনের জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা সহজে ভোলার নয়।
আল্লাহর দ্বীন কায়েমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কারণেই আলেম-ওলামাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। আলেম-ওলামারা সত্যের কথা বলেন, হকের কথা বলেন, ন্যায়ের কথা বলেন এবং অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই বাধার সম্মুখীন হন তারা।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের পবিত্র রমজান মাসে প্রায় আড়াই হাজার হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে আওয়ামী সরকার। বিশেষ করে আল্লামা মামুনুল হককে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় আমি মিরপুরে আমার মাদরাসায় এসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে ডিবির আট কর্মকর্তা উপস্থিত হন। তারা আমাকে বলেন, আপনি তো হেফাজতের বড় নেতা। আমি বললাম, আমি তো সহ-প্রচার সম্পাদক। আমার ওপরে আরও ৫০ নেতা আছেন।
তারা বলেন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে ডিবি অফিসে যেতে হবে। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি রেডি হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার আগে আমার কাছে থাকা মোবাইলটা সরাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা দ্রুত আমার মোবাইলটা নিয়ে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে রাখা একটি মাইক্রোতে করে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যান।
সেখানে কয়েকজন অফিসারের সামনে হাজির করে বলা হয়, আপনার কপাল খারাপ। ‘কেন’—জানতে চাইলে তারা বলেন, মাওলানা মামুনুল হক এইমাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন, আরও আগে গ্রেপ্তার হলে আপনারটা এড়িয়ে যাওয়া যেত। তাদের রহস্য বোঝা মুশকিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানেই রাখা হয়। সেখানে আরও কয়েকজন আলেম আটক ছিলেন।
আমার নাম-ঠিকানা জানার পর সেখানেই ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে একটি রুমে রাখা হয়, যেখানে এর আগে আরও বড় বড় নেতাকে রাখা হয়েছিল। যে রুমে সর্বোচ্চ চারজন থাকা যায়, সেখানে আমাদের ১০ জনকে রাখা হয়। এতে অনেক সময় বড় আলেমদের গায়ে পা লেগে যেত। গাদাগাদি করে আমাদের রাখা হয়।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, মামুনুল হককে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যখন ওই রুমে আনা হয়, তখন তার বসারও জায়গা ছিল না। পরে রাতে মামুনুল হককে একটি খাঁচার মতো রুমে রাখা হলো। সেখানেই তিনি রাতভর নামাজ পড়েন।
সারাদিন রোজা রেখে সেখানকার খাবার খাওয়া কতটা যে দুরূহ ব্যাপার ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। টয়লেটে যাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। অর্থাৎ যেখানে অমুসলিম দেশেও রমজান মাসকে শ্রদ্ধা করে, সেখানে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে রমজানের পবিত্র সময়ে আলেম-ওলামাদের ছোট রুমে আবদ্ধ রেখে নির্যাতন করা হয়।
পরের দিন পুলিশ হত্যা চেষ্টার মামলা দিয়ে আদালতে তোলা হয় মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমীকে। একটি মামলা হলেও তার ধারা ছিল অনেকগুলো। আদালতে বিচারক আমার বক্তব্য জানতে চাইলে আমি বলি, আমি তো বিগত দুই বছর গুলিস্তানের ওপারে যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোনোদিন আসিনি।
রমজানের পবিত্র মাসে আমাকে ভিত্তিহীন মিথ্যা পুলিশ হত্যাচেষ্টার মামলা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রশ্নই আসে না। আমরা জীবনে কাউকে ছোট ঢিলও ছুড়িনি, অথচ অন্যায়ভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। ধর্মকর্ম পালনের সুবিধার্থে রিমান্ড না দিয়ে বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাই। তখন বিচারক বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই। তখন সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে ডিবিতে রিমান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে আবার ১১ জনকে একটি রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয়। সাত দিনে আট-দশবারের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে।
এ সময় একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়; বলা হয়, আপনারা কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটালেন? বায়তুল মোকাররমের সংঘাতের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বলেছি, এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেখানে হেফাজতের কোনো কর্মসূচিও ছিল না। বারবার তারা এ ঘটনার সঙ্গে হেফাজতকে জড়ানোর চেষ্টা করে।
রিমান্ডে শীর্ষ আলেমদের সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, দিনে কয়েকবার করে তাদের ডাকা হতো। একদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবের চেহারা খুব মলিন দেখা যায়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, যেভাবে তারা চাপ প্রয়োগ করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আগামীকাল যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে কিছু একটা করে ফেলব। তখন তাকে যুগে যুগে আলেম-ওলামা নির্যাতনের বিষয় স্মরণ করিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করা হয়।
মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, রিমান্ডে আমাকে বারবার মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে আমি রাজি হইনি। সাত দিন ধরে নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমেও স্বীকারোক্তি নিতে ব্যর্থ হয় তারা। রিমান্ড শেষে ডিবি থেকে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে নিয়ে গারদে রাখা হয়।
তবে আদালতে হাজির করা হয়নি। তাকে এক রুম থেকে আরেক রুমে নেওয়ার সময় হ্যান্ডকাফ পরানো হতো। আমরা বলতাম, আমরা তো চোর-ডাকাত নই। আমাদের কেন হ্যান্ডকাফ পরাতে হবে? মারাত্মক অপরাধীকেও তো হাতকড়া পরানো হয় না। শীর্ষ আলেমদের কেন এক রুম থেকে আরেক রুমে নিতে হ্যান্ডকাফ পরাতে হবে? পুলিশ বলত, কিছুই করার নেই। আমাদের ওপরের নির্দেশ, হ্যান্ডকাফ পরাতেই হবে।
ডিবিতে রিমান্ড চলাকালে খাবারের খুব কষ্ট ছিল। ডাল-ভাত আর শুকনো টাটকিনি মাছ দেওয়া হতো। তাই সাহরিতে খাওয়া হতো। আর ইফতারে সামান্য কিছু আইটেম দেওয়া হতো। সেখানে নামাজ আদায় করা ছিল খুবই কষ্টকর। ছোট রুমে প্রচণ্ড গরমে কোনো রকমে নামাজ আদায় করতাম। সাত দিনে সেখানে ঘুমানোর কোনো সুযোগ পাইনি।
মুক্তির পরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিল না এই আলেমের। এক মাস পর আবার আদালতে হাজিরা দিতে হয় তাকে। এ সময় তাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়। একদিন এনএসআই থেকে তাকে চা খাওয়ার দাওয়াত দেওয়া হয়। তাদের দাওয়াতে গেলে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন তারা। একপর্যায়ে তাকে কিছু খেদমতের নামে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি কোনো সহযোগিতা নিতে রাজি না হলে তারা হতাশ হয়ে যান।
গ্রেপ্তারের পর পরিবারকেও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। মিরপুরে তার বাসার আশেপাশে কেউ যেতে সাহস পেতেন না, কারণ কাউকে সেখানে যেতে দেখলেই আওয়ামী লীগের লোকজন বা গোয়েন্দা ও অন্যান্য প্রশাসনের লোকেরা সন্দেহ করতে পারে এবং তাদের আটক করতে পারে বলে তারা মনে করতেন।
আশপাশের সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যেভাবে আতঙ্কিত ছিলেন, এই মাওলানার বাড়ির আশপাশের বাসিন্দাদেরও একই অবস্থা হয়েছিল। প্রায় এক মাস সবাই সতর্কভাবে চলাফেরা করেছেন। এসময় তার পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার মতো, বাজার করে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তাদের চরম অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে। আইন-আদালত করা, আইনজীবী ধরা—এসব কাজ করাও ছিল অসম্ভব।
সরকারের বিরুদ্ধে অপছন্দনীয় বক্তব্য দেওয়ায় মসজিদের খতিবের পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমীকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিরপুরের বায়তুল মোমেন জামে মসজিদের খতিব থাকাকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’
এটা তো কোনো মুসলমানের বক্তব্য হতে পারে না। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের লোকেরা থানায় ও এলাকাবাসীর মাঝে তাকে জঙ্গি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। তারা জঙ্গি মামলায় গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দেয়। একপর্যায়ে ওসি তাকে ডেকে তিনি কী বক্তব্য দিয়েছেন, তা জিজ্ঞাসা করেন। তবে স্থানীয় কিছু মানুষের প্রতিবাদের কারণে সেই ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পান তিনি।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ছিল বিগত সরকারের একটা কৌশল। এটা দিয়ে পশ্চিমাদের হাতে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আলেম-ওলামা ও দাড়ি-টুপিধারীদের জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল তারা। আজকে কোথায় সেই জঙ্গিবাদ।
সবাই তো দেশপ্রেমিক, এখানে কেউ জঙ্গি নয়। এভাবে দেশের তৌহিদি জনতা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনও অনেককে মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এখনও জুলুম থেকে অনেকে রেহাই পাননি। সরকার যেন সেসব মামলা থেকে নির্যাতিতদের রেহাই দেন। একইসঙ্গে যারা এসব জুলুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করারও আহ্বান জানান তিনি।
এমবি
মিরপুরে নিজের মাদরাসায় সকালে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী। পবিত্র রমজানের সেই সময়ে হঠাৎ সেখানে ডিবির একটি দল হানা দেয়। পরে ডিবি অফিসে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় তার কাছ থেকে।
একপর্যায়ে পুলিশ হত্যাচেষ্টার মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রথমে সাত দিন রিমান্ড এবং পরে জেলে পাঠানো হয় ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের এই সহ-প্রচার সম্পাদককে। এভাবে সাড়ে তিন মাস কাটাতে হয় জেলের অন্ধকারে।
মিরপুর তাহজিবুল উম্মাহ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী এসব তথ্য জানিয়ে আমার দেশকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের আলেম-ওলামাদের ওপর যে ধরনের জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা সহজে ভোলার নয়।
আল্লাহর দ্বীন কায়েমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কারণেই আলেম-ওলামাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। আলেম-ওলামারা সত্যের কথা বলেন, হকের কথা বলেন, ন্যায়ের কথা বলেন এবং অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই বাধার সম্মুখীন হন তারা।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের পবিত্র রমজান মাসে প্রায় আড়াই হাজার হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে আওয়ামী সরকার। বিশেষ করে আল্লামা মামুনুল হককে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় আমি মিরপুরে আমার মাদরাসায় এসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে ডিবির আট কর্মকর্তা উপস্থিত হন। তারা আমাকে বলেন, আপনি তো হেফাজতের বড় নেতা। আমি বললাম, আমি তো সহ-প্রচার সম্পাদক। আমার ওপরে আরও ৫০ নেতা আছেন।
তারা বলেন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে ডিবি অফিসে যেতে হবে। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি রেডি হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার আগে আমার কাছে থাকা মোবাইলটা সরাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা দ্রুত আমার মোবাইলটা নিয়ে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে রাখা একটি মাইক্রোতে করে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যান।
সেখানে কয়েকজন অফিসারের সামনে হাজির করে বলা হয়, আপনার কপাল খারাপ। ‘কেন’—জানতে চাইলে তারা বলেন, মাওলানা মামুনুল হক এইমাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন, আরও আগে গ্রেপ্তার হলে আপনারটা এড়িয়ে যাওয়া যেত। তাদের রহস্য বোঝা মুশকিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানেই রাখা হয়। সেখানে আরও কয়েকজন আলেম আটক ছিলেন।
আমার নাম-ঠিকানা জানার পর সেখানেই ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে একটি রুমে রাখা হয়, যেখানে এর আগে আরও বড় বড় নেতাকে রাখা হয়েছিল। যে রুমে সর্বোচ্চ চারজন থাকা যায়, সেখানে আমাদের ১০ জনকে রাখা হয়। এতে অনেক সময় বড় আলেমদের গায়ে পা লেগে যেত। গাদাগাদি করে আমাদের রাখা হয়।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, মামুনুল হককে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যখন ওই রুমে আনা হয়, তখন তার বসারও জায়গা ছিল না। পরে রাতে মামুনুল হককে একটি খাঁচার মতো রুমে রাখা হলো। সেখানেই তিনি রাতভর নামাজ পড়েন।
সারাদিন রোজা রেখে সেখানকার খাবার খাওয়া কতটা যে দুরূহ ব্যাপার ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। টয়লেটে যাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। অর্থাৎ যেখানে অমুসলিম দেশেও রমজান মাসকে শ্রদ্ধা করে, সেখানে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে রমজানের পবিত্র সময়ে আলেম-ওলামাদের ছোট রুমে আবদ্ধ রেখে নির্যাতন করা হয়।
পরের দিন পুলিশ হত্যা চেষ্টার মামলা দিয়ে আদালতে তোলা হয় মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমীকে। একটি মামলা হলেও তার ধারা ছিল অনেকগুলো। আদালতে বিচারক আমার বক্তব্য জানতে চাইলে আমি বলি, আমি তো বিগত দুই বছর গুলিস্তানের ওপারে যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোনোদিন আসিনি।
রমজানের পবিত্র মাসে আমাকে ভিত্তিহীন মিথ্যা পুলিশ হত্যাচেষ্টার মামলা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রশ্নই আসে না। আমরা জীবনে কাউকে ছোট ঢিলও ছুড়িনি, অথচ অন্যায়ভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। ধর্মকর্ম পালনের সুবিধার্থে রিমান্ড না দিয়ে বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাই। তখন বিচারক বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই। তখন সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে ডিবিতে রিমান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে আবার ১১ জনকে একটি রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয়। সাত দিনে আট-দশবারের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে।
এ সময় একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়; বলা হয়, আপনারা কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটালেন? বায়তুল মোকাররমের সংঘাতের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বলেছি, এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেখানে হেফাজতের কোনো কর্মসূচিও ছিল না। বারবার তারা এ ঘটনার সঙ্গে হেফাজতকে জড়ানোর চেষ্টা করে।
রিমান্ডে শীর্ষ আলেমদের সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, দিনে কয়েকবার করে তাদের ডাকা হতো। একদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবের চেহারা খুব মলিন দেখা যায়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, যেভাবে তারা চাপ প্রয়োগ করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আগামীকাল যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে কিছু একটা করে ফেলব। তখন তাকে যুগে যুগে আলেম-ওলামা নির্যাতনের বিষয় স্মরণ করিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করা হয়।
মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, রিমান্ডে আমাকে বারবার মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে আমি রাজি হইনি। সাত দিন ধরে নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমেও স্বীকারোক্তি নিতে ব্যর্থ হয় তারা। রিমান্ড শেষে ডিবি থেকে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে নিয়ে গারদে রাখা হয়।
তবে আদালতে হাজির করা হয়নি। তাকে এক রুম থেকে আরেক রুমে নেওয়ার সময় হ্যান্ডকাফ পরানো হতো। আমরা বলতাম, আমরা তো চোর-ডাকাত নই। আমাদের কেন হ্যান্ডকাফ পরাতে হবে? মারাত্মক অপরাধীকেও তো হাতকড়া পরানো হয় না। শীর্ষ আলেমদের কেন এক রুম থেকে আরেক রুমে নিতে হ্যান্ডকাফ পরাতে হবে? পুলিশ বলত, কিছুই করার নেই। আমাদের ওপরের নির্দেশ, হ্যান্ডকাফ পরাতেই হবে।
ডিবিতে রিমান্ড চলাকালে খাবারের খুব কষ্ট ছিল। ডাল-ভাত আর শুকনো টাটকিনি মাছ দেওয়া হতো। তাই সাহরিতে খাওয়া হতো। আর ইফতারে সামান্য কিছু আইটেম দেওয়া হতো। সেখানে নামাজ আদায় করা ছিল খুবই কষ্টকর। ছোট রুমে প্রচণ্ড গরমে কোনো রকমে নামাজ আদায় করতাম। সাত দিনে সেখানে ঘুমানোর কোনো সুযোগ পাইনি।
মুক্তির পরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিল না এই আলেমের। এক মাস পর আবার আদালতে হাজিরা দিতে হয় তাকে। এ সময় তাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়। একদিন এনএসআই থেকে তাকে চা খাওয়ার দাওয়াত দেওয়া হয়। তাদের দাওয়াতে গেলে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন তারা। একপর্যায়ে তাকে কিছু খেদমতের নামে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি কোনো সহযোগিতা নিতে রাজি না হলে তারা হতাশ হয়ে যান।
গ্রেপ্তারের পর পরিবারকেও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। মিরপুরে তার বাসার আশেপাশে কেউ যেতে সাহস পেতেন না, কারণ কাউকে সেখানে যেতে দেখলেই আওয়ামী লীগের লোকজন বা গোয়েন্দা ও অন্যান্য প্রশাসনের লোকেরা সন্দেহ করতে পারে এবং তাদের আটক করতে পারে বলে তারা মনে করতেন।
আশপাশের সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যেভাবে আতঙ্কিত ছিলেন, এই মাওলানার বাড়ির আশপাশের বাসিন্দাদেরও একই অবস্থা হয়েছিল। প্রায় এক মাস সবাই সতর্কভাবে চলাফেরা করেছেন। এসময় তার পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার মতো, বাজার করে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তাদের চরম অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে। আইন-আদালত করা, আইনজীবী ধরা—এসব কাজ করাও ছিল অসম্ভব।
সরকারের বিরুদ্ধে অপছন্দনীয় বক্তব্য দেওয়ায় মসজিদের খতিবের পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমীকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিরপুরের বায়তুল মোমেন জামে মসজিদের খতিব থাকাকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’
এটা তো কোনো মুসলমানের বক্তব্য হতে পারে না। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের লোকেরা থানায় ও এলাকাবাসীর মাঝে তাকে জঙ্গি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। তারা জঙ্গি মামলায় গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দেয়। একপর্যায়ে ওসি তাকে ডেকে তিনি কী বক্তব্য দিয়েছেন, তা জিজ্ঞাসা করেন। তবে স্থানীয় কিছু মানুষের প্রতিবাদের কারণে সেই ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পান তিনি।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ছিল বিগত সরকারের একটা কৌশল। এটা দিয়ে পশ্চিমাদের হাতে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আলেম-ওলামা ও দাড়ি-টুপিধারীদের জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল তারা। আজকে কোথায় সেই জঙ্গিবাদ।
সবাই তো দেশপ্রেমিক, এখানে কেউ জঙ্গি নয়। এভাবে দেশের তৌহিদি জনতা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনও অনেককে মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এখনও জুলুম থেকে অনেকে রেহাই পাননি। সরকার যেন সেসব মামলা থেকে নির্যাতিতদের রেহাই দেন। একইসঙ্গে যারা এসব জুলুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করারও আহ্বান জানান তিনি।
এমবি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১১ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
১ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
১ দিন আগে