জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে ভোগান্তি

ভর্তির অপেক্ষা যেন শেষ হয় না

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৩২

বছর তিনেক আগে ব্রেন টিউমার শনাক্ত হয় ইকবাল মাহমুদের (৪৪)। শুরুতে স্থানীয় চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ বোধ করলেও ক্রমেই বাড়তে থাকে মাথাব্যথা। শরীরের এক পাশে দুর্বলতা অনুভব করেন, চোখেও ঝাপসা দেখেন। জেলা সদর হাসপাতালে গেলে তাকে রাজধানীর জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যেতে বলেন চিকিৎসক। সেই মতে চলেও আসেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ ঘুরেও শয্যা পাননি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার এ বাসিন্দা।

গত সোমবার হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ইকবালকে। তিনি বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শে গত ১৭ সেপ্টেম্বর এ হাসপাতালে আসি। বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখালে তিনি ভর্তি হতে বলেন। কিন্তু ২০ দিন ঘুরেও ভর্তি হতে পারছি না। শুধু শুনছি সিট ফাঁকা নেই, হলেই নেবে। কিন্তু অপেক্ষা আর শেষ হয় না।

বিজ্ঞাপন

ইকবাল বলেন, ঢাকায় আত্মীয়স্বজন না থাকায় হোটেলে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু কতদিন এভাবে থাকা যায়? চিকিৎসা শুরুই করতে পারলাম না, তার আগেই খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেক।

চিকিৎসার জন্য এসে শয্যা পাওয়া নিয়ে এমন চরম ভোগান্তির অভিজ্ঞতা শুধু ইকবাল মাহমুদের নয়, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে আসা ভর্তিযোগ্য হাজারো রোগীর। সরেজমিনে গত দু-দিন হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

বিষয়টি স্বীকার করে হাসপাতালটির যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম আমার দেশকে বলেন, সারা দেশের রোগী এখানে আসলেও আমাদের সক্ষমতা ৫০০ রোগী ভর্তির। ফলে অনেক রোগীকে ফেরত যেতে হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও আমাদের এ বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে।

রোগীপ্রতি চিকিৎসকদের সময় এক মিনিট

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের বহির্বিভাগে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ রোগী চিকিৎসা নেয় নেয়, যার এক-তৃতীয়াংশই নিউরোমেডিসিনের। বাকিরা নিউরোসার্জারি, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি, পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারির। একেকজন চিকিৎসককে দৈনিক গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী দেখতে হয়। ফলে রোগী প্রতি সর্বোচ্চ এক মিনিট বরাদ্দ দিতে পারেন চিকিৎসকরা।

বহির্ভাগের চিকিৎসক হাসপাতালটির নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক সার্জন মো. বশির উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, রোগীদের তীব্র চাপ সামলাতে আমাদেরে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। দিনে যেখানে একজন চিকিৎসকের সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখার কথা, সেখানে ২৫০ জন, কখনো ৩০০ জন রোগীও দেখতে হচ্ছে। ফলে একজন রোগীকে সর্বোচ্চ এক মিনিটের মতো দেখার সুযোগ হচ্ছে। তাহলে রোগীকে কাউন্সেলিং করব কখন, ঠান্ডা মাথায় পরামর্শই দেব কীভাবে।

ভর্তিযোগ্য ৮০ ভাগ, হতে পারে ১০ ভাগ

বহির্বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে। সে সময় যে পরিমাণে রোগী আসত, বর্তমানে আসছে তার ছয়গুণ বেশি। আবার বছর কয়েক আগেও বহির্বিভাগের রোগীদের ৫০ শতাংশ ছিল ভর্তিযোগ্য, বর্তমানে তা ৮০ ভাগের বেশি। কিন্তু শয্যা সংকটে দিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ রোগী ভর্তি হতে পারছে।

তবে তদবিরে মেলে শয্যা

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীরা যখন একটি শয্যা পেতে দিনের পর দিন হাসপাতালের করিডোরে ঘুরে ফিরছেন, তখন অনেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিক, চিকিৎসক নেতা, পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তার তদবিরে সহজেই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে আরো সীমিত হয়ে আসছে সাধারণ মানুষের ভর্তির সুযোগ।

এমনই তদবিরে সহজে শয্যা পেয়েছেন মুবারক হোসেন (ছদ্ম নাম)। মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে আসলে ভর্তি হতে বলেন চিকিৎসক। তবে শয্যা নেই বলে তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের একজনের তদবিরে পরদিনই শয্যা পেয়ে যান লক্ষ্মীপুর থেকে আসা পঞ্চাশোর্ধ্ব মুবারক।

গত শনিবার হাসপাতালের ওয়ার্ডে কথা হয় মুবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শয্যা পাওয়াটাই এখানে সোনার হরিণ। বহু রোগী শয্যার অভাবে ফেরত যাচ্ছে। আমরাও হয়তো পেতাম না। এক

আত্মীয়ের মাধ্যমে একজন সচিবকে ধরে ভর্তি হয়েছি।

তদবিরে ভর্তির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, কিছু যে তদবিরে হচ্ছে না, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। সরকারি চাকরি করলে, বিশেষ করে হাসপাতালে কাজ করলে নিজের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে অনেকের অনুরোধ আসে। তবে আমরা চেষ্টা করি রোগীর অবস্থা কতটা ক্রিটিক্যাল ও তার রোগের অবস্থা বিবেচনায় নিতে।

তিনি আরো বলেন, এ হাসপাতালের প্রতি মানুষের যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জের। কারণ, প্রতিনিয়ত ভর্তিযোগ্য রোগী আসলেও খুব কম সংখ্যককেই ভর্তি করা যাচ্ছে। বর্ধিত হাসপাতালটি চালু হলে এ সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে আশা করছি।

আগামী মাসে চালু হতে পারে ৫০০ শয্যার বর্ধিত হাসপাতাল

জানা গেছে, রোগীর চাপ সামলাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নতুন করে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট বর্ধিত হাসপাতাল চালুর উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রায় সাত বছর কাজ শেষ করে চলতি বছরের জুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ভবনটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে গণপূর্ত বিভাগ।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৫ তলা বিশিষ্ট বর্ধিত হাসপাতালটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০৬ কোটি টাকা। যেখানে সেন্ট্রাল এসির (কেন্দ্রীয় শীতাতপ ব্যবস্থা) পাশাপাশি থাকছে অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা যন্ত্র। সিটি স্ক্যান, ক্যাথ ল্যাব, ২০ শয্যার আইসিইউ ছাড়াও থাকছে ১০০ শয্যার নিউরো ট্রমা সেন্টার।

তবে জনবল নিয়োগ চূড়ান্ত করতে না পারায় এটি চালু হতে দেরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ হয়েছে। চলছে টেকনোলজিস্টসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া। সবকিছু শেষ করে আগামী মাসে বর্ধিত এ অংশটি চালুর পরিকল্পনা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম আমার দেশকে বলেন, রোগীদের দুর্ভোগ দেখে আমরা ক্লান্ত। এজন্য হাসপাতালটি দ্রুত চালু করতে চাই। ইতোমধ্যে চিকিৎসক নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, কিন্তু নার্স দিচ্ছে মাত্র ৩০০। এটি সেবার মানে প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া অন্যান্য জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। আরো আগেই চালু করা যেত। কিন্তু উদ্বোধন করে নামমাত্র নয়, পুরো সেবাই চালু করাই আমাদের লক্ষ্য। এজন্য একটু দেরি হচ্ছে। তবে আগামী মাসেই চালুর প্রত্যাশা রয়েছে।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত