জনবলের অভাবে অচল ৮১ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬: ৩২

উত্তরাঞ্চলের শিশু রোগীদের কম সময়ে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা দিতে দুই বছর আগে নির্মাণ করা হয় রাজশাহী শিশু হাসপাতাল। কিন্তু এখনো চালু হয়নি ২০০ শয্যার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। তবে কার অধীনে পরিচালনা করা হবে, সেটি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় হয়নি জনবল নিয়োগ। জনবল সংকটে অলস পড়ে আছে চিকিৎসা সরঞ্জাম। একজন নিরাপত্তা প্রহরী ভবনটি পাহারা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে চুরি হচ্ছে মূল্যবান সব যন্ত্রপাতি ও মালামাল।

রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. এসআইএম রাজিউল করিম আমার দেশকে বলেন, ‘আমার যোগদানের আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একাধিবার চিঠি দেওয়া হয়। সেখান থেকে জনবল নিয়োগের বা হাসপাতালটি কীভাবে চালু হবে, তা নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। এ কারণে ভবনটি বুঝে নেওয়া যায়নি। তবে আসবাবপত্র কেনার জন্য চলতি মাসে আট কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসা দিতে মাদারীপুরের শিবচরের দত্তপাড়ায় নির্মাণ করা হয় ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ট্রমা সেন্টার, যেখানে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি টাকা। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ২০২২ সালের নভেম্বরে সেন্টারটি উদ্বোধন করেন। তবে উদ্বোধনের তিন বছরেও সেটি চালু হয়নি।

শুধু এ দুই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠাই নয়; বরং সারা দেশে অন্তত ৮১টি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকলেও কেবল জনবলের অভাবে সচল করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশে রোগী অনুযায়ী ১৫ হাজারের বেশি শয্যার ঘাটতি রয়েছে। ফলে অধিকাংশ রোগীকে ঢাকায় ছুটতে হয়। অথচ ৮১টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পড়ে আছে। জনবল দিয়ে এক হাজার শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্যমতে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য বিভিন্ন সময় ২১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ১০টি হয়েছে বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের আমলে। বাকি ১১টি ২০১০ সালে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২১টি ট্রমা সেন্টারের মধ্যে দুটির নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। অন্য দুটিতে বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। এছাড়া একটি সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের কার্যক্রম চালাতে ব্যবহার হচ্ছে। বাকি ১৬টির ভবন ও অধিকাংশে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি থাকলেও জনবল না থাকায় অচল পড়ে আছে। কোথাও কোথাও ভবনই পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম।

সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব সেন্টার নির্মাণ করা হয়। এজন্য প্রতিটি ট্রমা সেন্টারে সাতজন পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালট্যান্ট), তিনজন অর্থোপেডিকস সার্জন, দুজন অ্যানেসথেসিস্ট, দুজন আবাসিক চিকিৎসক, ১০ জন নার্স, ফার্মাসিস্ট ও টেকনিশিয়ানসহ ৩৪টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় দুই যুগেও কোনো সেন্টারেই পদ অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে, ঢাকায় চাপ কমাতে ও স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা দিতে ২০১৬ সালে ঢাকার বাইরে পাঁচটি বৃহত্তর শহর রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা ও বরিশালে ২০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২৩ সালে এগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়। কিন্তু একমাত্র রংপুরে প্রাথমিক সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি চারটির কোনোটিই পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। জনবলের অভাবে স্থবির এসব প্রতিষ্ঠানের চাপ পড়ছে বিভাগীয় ও ঢাকার হাসপাতালগুলোয়। এতে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারিতে চিকিৎসা করার মতো নিম্নআয়ের মানুষের সামর্থ্য না থাকায় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে।

অচল পড়ে থাকা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে ওঠা ১০, ২০, ১৫০ ও ২৫০ শয্যার হাসপাতালও। এছাড়া সারা দেশে ১৬টি ম্যাটস রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি চালু থাকলেও জনবলের অভাবে অচল ৯টি। এসব ম্যাটসকে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর আমার দেশকে বলেন, ‘বিগত সময়ে অনেকগুলো স্বাস্থ্য ভবন হয়েছে, যেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। আবার কিছু জায়গায় যন্ত্রপাতি আছে কিন্তু জনবল নেই। জনবল সৃষ্টি না করেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। এগুলোকে কীভাবে সচল করা যায়, সে উপায় বের করার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে যেসব শিশু হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোকে চালু করতে স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে যেহেতু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়েছে, ফলে সবগুলো চালু করা সম্ভব হবে না।’

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময় স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি চিকিৎসা শিক্ষায় অপরিকল্পিত প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। কীভাবে চলবে, তা ঠিক না করেই নির্মাণ করায় রাষ্ট্রের অর্থ অপচায় হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় ম্যাটস ও আইএইচটি (ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি) মিলে ১০টি ভবন অচল রয়েছে। এগুলোয় গ্রামীণ পরিবেশে চিকিৎসকসহ অন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘যে ৮১টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান অচল পড়ে আছে, এর বড় অংশে প্রধান সমস্যা জনবলের অভাব। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। অথচ আমাদের হাসপাতালগুলোয় রোগীদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। রোগী অনুযায়ী সারা দেশে ১৫ হাজার শয্যার ঘাটতি রয়েছে। তাই অচল এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত এক হাজার শয্যা আগামী অক্টোবরের মধ্যে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত