দেশবিরোধী অপপ্রচারে আওয়ামী নারীরা

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫: ৪৫
আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৪৮

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়। বিপ্লবের মুখে পালিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রী-এমপিদের বড় একটি অংশ ভারতে এবং বাকিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। বেশিরভাগ হেভিওয়েট গোপনে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকলেও দেশ-বিদেশে অবস্থানরত নারী দোসররা এখন সামাজিকমাধ্যমে বেশ সরব।

তাদের অনেকে নিজ নামের আইডি পরিবর্তন করে কিংবা ছদ্মনামে নতুন আইডি খুলে অপপ্রচারে সরব। অনেকে আবার আসল পরিচয়েই চালিয়ে যাচ্ছে দেশবিরোধী কার্যক্রম। অনেকে নিজের আগের আইডির সব তথ্য মুছে ফেলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে পোস্ট দিলেও তাদের রয়েছে একাধিক ছদ্মনামের আইডি। সেসব আইডি থেকে তারা নিয়মিত উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এমনকি ওই নারী দোসররা বিভিন্ন অ্যাপস কিংবা অনলাইন মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে আওয়ামী লীগের পলাতক হাইকমান্ডের সঙ্গেও। এক্ষেত্রে তারা টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগলমিট ও ভাইবার অ্যাপস বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেখানে গোপন কলে কিংবা মেসেজে বিভিন্ন যড়যন্ত্র ও অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে।

দেশ-বিদেশে এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নারী দোসরদের সংখ্যা কয়েক লাখ। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, বেশি সক্রিয় এমন সংখ্যা কয়েক হাজার।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল

শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, যিনি একসময় নিজেকে প্রখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিতেন। তিনি ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভের জন্য দাখিল করা সিভিতে জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ও ভুয়া যোগ্যতা উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়ার পর প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়েছে। এরপর থেকেই পুতুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সরব হয়ে উঠেছেন।

সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় পুতুল বলেন, ‘মা কিছুটা অসুস্থ। মায়ের অভ্যাস ছিল ঘুরে বেড়ানো, সেটা করতে পারছে না। সে কারণে মা কিছুটা অসুস্থ। … আম্মা আপনাদের অনেক মিস করে। আম্মা নেতাকর্মীদের অনেক মিস করে।’

এছাড়া পুতুলের নিত্যনতুন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামীদিনে আওয়ামী লীগ পুতুলকে সামনে রেখেই এগোতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে পলাতক স্বৈরাচার হাসিনাও দলীয় নেতাকর্মীদের সবুজ সংকেত দিয়েছেন। তাই পুতুল এখন সামাজিকমাধ্যমে বেশ সরব হয়ে উঠছেন।

বাহারকন্যা সূচনা

কুমিল্লার আলোচিত এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে ও সাবেক সিটি মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা পালিয়ে ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই এখন তিনি সামাজিকমাধ্যমে বেশ সরব হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন পোস্ট দিয়ে জানান দিচ্ছেন এবং নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা রাখার চেষ্টা করছেন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার জন্মদিনে ‘অন্ধকার দুঃশাসনে একমাত্র আলো শেখ হাসিনা’ শিরোনামে নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন সূচনা। ওই পোস্টে তিনি শেখ হাসিনার গুণকীর্তন এবং ড. মুহাম্মাদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে বিষোদ্গার করেন।

এর আগে ৬ আগস্ট এক পোস্টে লেখেন- ‘এই দেশের রাজনীতিতে অনেক কিছু হতে পারে কিন্তু ইতিহাসে রাজাকার কখনো মুক্তিযোদ্ধা হবে না। রাজাকারের পরিচয় একমাত্র রাজাকার। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতায় ইতিহাস যেন কেউ বদলাতে না পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে নতুন প্রজন্মকে। জানতে হবে রাজাকারদের পরিচয়...।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহিলা লীগের সম্পাদক হালিমা

হালিমা বেগম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিনে তিনি লেখেন- ‘শুভ জন্মদিন আপা। আপার শুভ জন্মদিনে অনেক অনেক দোয়াসহ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই। মহান আল্লাহপাকের দরবারে প্রার্থনা করি- আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।’

এর আগে ২৭ জুলাই তিনি শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন উপলক্ষে পোস্টে লেখেন- ‘শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল। সজীব ওয়াজেদ জয় মামাজান। আগামীর রাষ্ট্রনায়ক। আপনার জন্য দোয়া ও শুভকামনা রইল।’

আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক সুলতানা রহমান

এই নারী সাংবাদিক ফ্যাসিবাদের পক্ষে ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় বেশ সোচ্চার। সম্প্রতি তিনি ফেসবুক পোস্টে লেখেন-‘তাহলে শিবির ক্যাডারদের সাংবাদিক সাজিয়ে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী করা হয়েছে নিউ ইয়র্কে মব করার জন্য? আর সেজন্যই এত লুকোছাপা? ফ্যাসিজম কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী- এখনকার বাংলাদেশ তার নমুনা।’

এর কয়েকদিন আগে অবশ্য নিউ ইয়র্কে প্রবাসী সাংবাদিক সুলতানা রহমানের ওপর আওয়ামী লীগই হামলা চালায়। নিউ ইয়র্কের কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় ২২ সেপ্টেম্বর ‘একাত্তরের প্রহরী’ নামক একটি সংগঠনের সভায় তার বক্তব্য দেওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। ‘একাত্তরের প্রহরী’ রোববার সন্ধ্যায় আসাদুজ্জামান নূর, শাহরিয়ার কবিরসহ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সভা করে। ওই সভায় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যোগ দিয়ে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের তীব্র সমালোচনা করে।

জ্যোতিকা জ্যোতি

ফ্যাসিবাদের নারী দোসরদের মধ্যে যারা বেশি সরব তাদের মধ্যে অন্যতম চিত্রনায়িকা জ্যোতিকা জ্যোতি। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকতে না পারায় সর্বশেষ তাকে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক পদ দেওয়া হয়। বিগত ১৫ বছরে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজ এলাকা নেত্রকোনায় দখলবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ছাত্রজীবনে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে পরিবারটি ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে। কলেজজীবনে বিয়ে করলেও সর্বত্র নিজেকে অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন।

৫ আগস্টের পর শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে পদ আঁকড়ে রাখতে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেন। বছরজুড়েই বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সামাজিকমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন। কয়েকদিন আগেও ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধীদের কঠোর সমালোচনা করে পোস্ট করেন।

চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিনেমায় কাজের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সরব ছিলেন অপু বিশ্বাস। পেয়েছিলেন সরকারি অনুদানের সিনেমাসহ বিভিন্ন সুবিধা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন তিনি। যদিও মনোনয়ন জোটেনি তার ভাগ্যে। তবুও সরব ছিলেন বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনি প্রচারে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে নিজের ভোল পাল্টাতে শুরু করেন। যদিও তিনি ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত কালচারাল দোসর। জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যা মামলার আসামিও এই নায়িকা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সরাসরি কোনো পোস্ট না করলেও আকার-ইঙ্গিতে যেসব পোস্ট দেন, তা ফ্যাসিবাদের পক্ষেই তার অবস্থান বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা রঙের অক্ষরে অপু লেখেন, ‘সত্য হলো এমন একটি শক্তি, যা কোনো অবস্থাতেই চিরস্থায়ীভাবে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মিথ্যা যতই শক্তিশালী হোক, সত্যের জ্যোতি তাকে পরাজিত করে।’

এদিকে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরব অপু বিশ্বাসকে চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলার খোকসায় বিএনপির একটি অনুষ্ঠানে দেখা যায়। এ নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে তাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই তাকে বসন্তের কোকিল আখ্যা দিয়েছেন।

এছাড়া সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের স্ত্রী-সন্তানরা বিভিন্ন ছদ্মনামে আইডি খুলে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অন্যায্য সমালোচনায় সরব আছে। সচেতন মহলের দাবি, এসব বিষয়ে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ক্রমেই বাড়ছে গুজবের ডালপালা।

তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত