আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

অভিবাসনে ব্যয় বেড়েছে, কমেনি হয়রানি

পীর জুবায়ের

অভিবাসনে ব্যয় বেড়েছে, কমেনি হয়রানি
প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস আজ বৃহস্পতিবার। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ে রেকর্ড গড়লেও, অভিবাসন খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা এখনো কাটেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশগামী শ্রমিকদের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও বিমানবন্দরে হয়রানি, দালালদের দৌরাত্ম্য এবং বিদেশে গিয়ে বঞ্চনার শিকার হওয়ার ঘটনা কমেনি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ৭ লাখ ১৫ হাজারের বেশি কর্মী। এছাড়া কাতারে এক লাখ চার হাজারের বেশি, কুয়েতে ৪১ হাজারের বেশি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১৩ হাজার কর্মী গেছেন।

বিজ্ঞাপন

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৪টি দেশে কর্মী পাঠাতে ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক লাখ সাত হাজার টাকা, কুয়েতে এক লাখ ছয় হাজার টাকা এবং ওমানে প্রায় এক লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই তালিকায় রয়েছে লিবিয়া, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, কাতার, জর্ডান, মিসর, ইরাক, রাশিয়া, মালদ্বীপ, ব্রুনাই ও লেবানন। তবে বাস্তবে এসব দেশে যেতে নির্ধারিত ব্যয়ের দুই থেকে তিন গুণ টাকা খরচ করতে হচ্ছে বিদেশগামী শ্রমিকদের।

অভিবাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একজন শ্রমিকের সরাসরি ভিসা পাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিক্রুটিং এজেন্সি কিংবা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। ফলে ভিসা হাতবদল, অতিরিক্ত বিমান ভাড়া ও মধ্যস্বত্বভোগীর কমিশনে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়।

অভিযোগ আছে, বিএমইটি কিংবা মন্ত্রণালয়ের সঠিক তদারকির অভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন প্রবাসীরা। এর ফলে অনেক দক্ষ শ্রমিক ইচ্ছা থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত দেশে যেতে পারছেন না। আবার গেলেও চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সৌদিতে কাজ, আয় মিলছে না কথামতো

জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেতে কর্মীপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। সৌদি আরবে কর্মরত কয়েকজন প্রবাসী জানান, তারা ক্লিনারের কাজে যেতে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। সেখানে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পান ৭০০ রিয়াল, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ হাজার ৪০০ টাকা। দুই বছরে মোট আয় দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকা। জীবনযাপনের খরচ বাদ দিলে দেশে পাঠানোর মতো থাকে তিন লাখ টাকার কিছু বেশি। অথচ দালালরা তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন মাসিক বেতন হবে অন্তত ৫০ হাজার টাকা। প্রবাসীরা বলছেন, এ ধরনের প্রতারণা শুধু সৌদি আরবেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই ঘটছে।

বিমানবন্দরেও অভিযোগ

প্রবাসীদের অভিযোগ, মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দুর্বল তদারকির কারণে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এক ভিসার কথা বলে অন্য ভিসা দেওয়া, কোম্পানির কাজের কথা বলে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না পাওয়া—এমন অভিযোগও রয়েছে।

এ ছাড়া বিমানবন্দরে প্রবাসীদের নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা শ্রমিকদের চেকিংয়ের নামে অযথা সময় ক্ষেপণ, অহেতুক প্রশ্ন ও কৃত্রিম জটিলতার মুখে পড়তে হয়। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ইমিগ্রেশনে অপ্রয়োজনীয় বাধার কারণে কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, এমনকি ফ্লাইট মিস করার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটে।

কাতার প্রবাসী সগির আহমদ তালুকদার বলেন, এজেন্সিগুলো প্রথমে মিষ্টি কথা বলে পাসপোর্ট নেয়। পরে একের পর এক অজুহাতে টাকা আদায় করে। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকে না।

মালয়েশিয়া প্রবাসী শুভ আমার দেশকে বলেন, আমরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখি, অথচ আমাদের সঙ্গেই খারাপ আচরণ করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, তবুও বিমানবন্দরে প্রবাসীদের মর্যাদা বাড়েনি। এক কথায় বলতে গেলে আমরা সবখানেই অসহায়।

তিনি অভিযোগ করেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের সঙ্গে বিমানবন্দরে বন্ধুসুলভ আচরণ করা হয় না। অথচ অন্যদের স্যার বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। আমরা কষ্ট করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে ভালো রেখেছি। আর আমরাই অবহেলার শিকার হচ্ছি।

বিশেষজ্ঞদের মত

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির আমার দেশকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করার অন্যতম শক্তি প্রবাসীরা। তাদের যেন কোনো রকম হয়রানি করা না হয় তাই সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উচিত সব সময় খেয়াল রাখা। এজন্য মন্ত্রণালয়কে প্রবাসীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার একটা কার্যকর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। যাতে যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রবাসীরা সরকারকে সরাসরি অবগত করতে পারেন। তবে শুধু অবগত করলেই হবে না, দায়িত্বরতরা যদি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন তাহলে সুফল মিলবে। এর ফলে রিক্রুট এজেন্সি কর্তৃক কিংবা বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি কমতে পারে।

সরকারের বক্তব্য

মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব এজেডএম নুরুল হক এ বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রমাণসহ অভিযোগ করলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন