ভোরের কুয়াশা আর দুপুরের রোদের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন ভ্যান চালাতেন সুরুজ আলী। হ্যান্ডেলে শক্ত করে ধরা দু’হাত, চোখে একটাই দৃশ্য,ছেলে সাদা অ্যাপ্রন গায়ে মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। সময় বদলেছে, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বদলায়নি। অবশেষে সেই স্বপ্নই বাস্তব হয়েছে। ছোট ছেলে মো. সানাউল্লাহ ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস–বিডিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
এই সাফল্যের পেছনে নেই কোনো কোচিংয়ের আড়ম্বর কিংবা বিত্তশালীর ছায়া। আছে দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রাম। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুরা গ্রাম থেকে জীবিকার তাগিদে প্রায় ২০ বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে এসে থিতু হন সুরুজ আলী। পরিবার নিয়ে মাওনা উত্তরপাড়া গ্রামের সুরুজ আলী ভাড়া বাসায় থাকেন। শুরুটা ছিল দিনমজুর হিসেবে, পরে গত ১২ বছর ধরে ভ্যানই তাঁর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। উপার্জন সামান্য, কিন্তু মনোবল অটুট।
পাঁচ সদস্যের পরিবারে প্রতিদিনের খরচ চালানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ কখনো কোনো কিছুকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি তিনি। অনেক রাত জেগে বাড়তি খাটুনি করেছেন শুধু বই–খাতার টাকার জন্য। সংসারের ভার লাঘব করতে স্ত্রী আফরোজা খাতুন স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে কাজ নেন। পরিবারজুড়ে ছিল একটাই অঙ্গীকার,পড়াশোনা থামবে না।
সেই অঙ্গীকারের ফল আজ দৃশ্যমান। সানাউল্লাহ শ্রীপুরের হাজী ছোট কলিম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ–৫ অর্জন করেন। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে এবার তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
ছেলের সাফল্যের খবরে আবেগে কেঁপে ওঠে সুরুজ আলীর কণ্ঠ। বলেন, ‘আমি বেশি পড়তে পারি নাই। কিন্তু স্বপ্ন দেখছি আমার সন্তানরা পড়াশোনা করবে। আজ ছেলে মেডিকেলে চান্স পাইছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার জীবনে নাই।’
তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে আমিরুন নেসা বর্তমানে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। দ্বিতীয় ছেলে ওলি উল্লাহ উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আর ছোট ছেলে সানাউল্লাহ এখন পরিবারটির সবচেয়ে বড় আশার নাম।
নিজের সাফল্য প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ বলেন, মা–বাবার ত্যাগই তাকে এগিয়ে যেতে সাহস দিয়েছে। তিনি চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান।
সানাউল্লাহর শৈশবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাজী ছোট কলিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান সজল বলেন,
“এই অর্জন শুধু একটি পরিবারের নয়, এটি সমাজের জন্যও অনুপ্রেরণা। আমরা বিশ্বাস করি, সানাউল্লাহ একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।”
ভ্যানের চাকার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে যে স্বপ্ন লালন করেছিলেন সুরুজ আলী, আজ সেই স্বপ্নই নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের সেবা করার শপথ নিয়ে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

