ভারতের পানিতে টইটম্বুর পদ্মা, তিন মাসেই শুকিয়ে কাঠ হবে

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১২: ৫২

শুকিয়ে খালে পরিণত হয়ে যাওয়া একসময়ের প্রমত্ত পদ্মায় ভারতের উজান থেকে নেমে আসছে অভিশপ্ত অতিথি পানি। এই পানিতে পদ্মায় প্রাণ ফিরলেও মাত্র তিন মাসও তা স্থায়ী থাকবে না। এর মধ্যে ফের শুষ্কতায় রূপ নেবে।

অথচ একসময় বছরজুড়েই পানিতে টইটম্বুর ছিল নদীটি। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় জানমালের প্রতি বছর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া বাকি সময় পানি না পাওয়ায় অসংখ্য নদ-নদী শুকিয়ে জীববৈচিত্র্য ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই পদ্মার তীরবর্তী মানুষ এ মৌসুমি পানিকে অভিশপ্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট থেকে ঈশ্বরদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত দুইশ মাইলজুড়ে খালে রূপ নেওয়া পদ্মায় জুলাই মাসের প্রথম থেকে পানি বাড়তে শুরু করেছে। চরাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, মাস তিনেক ঠিকমতো পানি থাকে পদ্মায়। বছরের বাকি সময় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। নৌকাও চলে না ঠিকমতো। জেগে ওঠে চর এবং প্রতি বছর বাড়ে এর বিস্তৃতিও।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জুন পদ্মার রাজশাহী সীমান্তে পানি ছিল ১০ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার। এরপর ৩১ জুলাই রাজশাহী সীমান্তে পদ্মা নদীর পানি ছিল ১৫ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার। ১ আগস্ট পদ্মায় পানি ছিল ১৫ দশমিক ৮১ সেন্টিমিটার, ২ আগস্ট ১৫ দশমিক ৯৫, ৩ আগস্ট ১৬ দশমিক ১৮, ৪ আগস্ট ১৬ দশমিক ৪২, ৫ আগস্ট ১৬ দশমিক ৫৪ এবং ৬ আগস্ট ১৬ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার। এভাবেই প্রতিদিন বাড়ছে পদ্মার পানি।

পাউবোর দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি সূত্রে জানায়, গত বছরের ৫ অক্টোবর ভরা মৌসুমে পদ্মার পানির সর্বোচ্চ গভীরতা পাওয়া গিয়েছিল ১৬ দশমিক ৭০ মিটার। এরপর থেকে পানি কমতে শুরু করে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই গভীরতা ৯ দশমিক ৪০ মিটারে নেমে এসেছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই পানি কমতে কমতে প্রমত্ত পদ্মা খালে পরিণত হয়ে পড়ে।

গবেষকরা বলছেন, ফারাক্কা চুক্তির পর বাংলাদেশ পানি পায় শুধু বর্ষা মৌসুমে। কিন্তু সারা বছরের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে চুক্তি রক্ষা করেনি ভারত। চুক্তির নামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০২৬ সালে চুক্তি নবায়ন হওয়ার কথা। তখন যেন গ্যারান্টি ক্লজ ও ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে এখনই সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছে পদ্মাপাড়ের মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মায় পানির সঙ্গে ভেসে আসছে কচুরিপানা। কচুরিপানাগুলো উজান থেকে স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসছে। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা ছোট চরগুলোতে পানি উঠেছে। যদিওবা এই চরগুলোতে মানুষের বসবাস নেই তবে গবাদিপশুর বিচরণ রয়েছে।

প্রায় ৩৭ বছর নদীতে থাকার অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে আরমান মাঝি বলেন, পদ্মার অনেক শাখা নদীও গত ৫০ বছরে শুকিয়ে গেছে। আগে পদ্মা কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। শুষ্ক মৌসুমে এখন অনেক জায়গায় সরু খালের মতো পানি প্রবাহিত হয়। বর্ষায় ভারত ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে আমাদের ভাসিয়ে দেয়।

পদ্মাপাড়ের বুলনপুর এলাকার সাদেক আলী মাস্টার বলেন, বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ে। পদ্মার পানি ১৫ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে নদী ভরে যায়। তবে এই পানি মাত্র কয়েক মাস থেকে আবার শুকিয়ে যায়।

পদ্মাপাড়ের মাঝি আমিনুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকে নদীতে সাঁতার দিয়েছি। তখন পদ্মা ছিল ব্যাপক খরস্রোতা। শুষ্ক মৌসুমে মরা খালে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দিলে ভারতের উজানের পানিতে প্রতি বছর জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু পানি ব্যবস্থাপনার কোনো পরিবর্তন হয় না।

গোদাগাড়ী উপজেলার আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের মেম্বার জোহরুর ইসলাম জানান, পদ্মায় প্রতিদিন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে পানি। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীপাড়ের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহর রক্ষা শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু হুরায়রা বলেন, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পেলেও রাজশাহী নগরীর কোথাও কোনো ভাঙন বা বাঁধে ফাটল দেখা যায়নি। এছাড়া রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা ও পবার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়নি। তবে গোদাগাড়ীর নিমতলা ও চর-আষাড়িয়াদহ এলাকায় পদ্মার স্রোতে বড় অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, অতিথি পানির কারণে পদ্মায় তিন মাসের জন্য যৌবন আসে। ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে প্রতি বছর ফারাক্কার গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়। জেগে ওঠে পদ্মা। বন্যার চাপ কমলে গেটগুলো ফের বন্ধ হয়ে যায়। নদী ফের মরে যায়।

বিশিষ্ট নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে শুকনো মৌসুম। মৌসুমের ৩১ মে পর্যন্ত উভয় দেশ দশ দিন করে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক কখনো পানি পায়নি। এ নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে ভারত পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত