অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্প

আহসান কবীর, যশোর
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৮: ৩৭

জন্ম থেকেই চার হাত-পায়ের একটিও নেই মেয়েটির। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাচল করতে পারে না। ক্লাসের সবাই লেখে কলম হাতে ধরে। অথচ এই মেয়েটির তো হাতই নেই। তাই তাকে কলম ধরতে হয় মুখ দিয়ে। সেই মেয়ে কিনা একের পর এক তাক লাগিয়ে চলেছে! জীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কখনও ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি সে।

এবারের এসএসসি পরীক্ষাতেও তার স্কুল থেকে সব বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে একমাত্র এই মেয়েটি। চেনা মহলে লিতুনজিরা মানেই যেন চমক, অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্প।

বিজ্ঞাপন

এই সাফল্যে যারপরনাই আনন্দিত যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খানপুর গ্রামের লিতুনজিরা ছাড়াও তার পরিবার, শিক্ষক, প্রতিবেশী এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও। হেরে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা কখনও মাথায় না আনা লিতুনজিরার ভাবনায় এখন শুধুই প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।

২০০৮ সালের ২৫ জুন। দ্বিতীয় সন্তানসম্ভবা স্ত্রী জাহানারা বেগমকে নিজ মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে বাপের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন হাবিবুর রহমান। পথেই জাহানারার প্রসববেদনা ওঠে। বাপের বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন জাহানারা। কিন্তু হায়! সদ্যজাত এই সন্তানের যে কোনো হাত-পা নেই! এই বাচ্চা কীভাবে বাঁচবে, আর বাঁচলেই বা তাকে কীভাবে মানুষ করবেন?- এই চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হাবিবুর রহমান।

‘আমি অসুস্থ অবস্থায় জ্ঞান হারাই। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরলে স্বজনরা বাচ্চাটিকে আমার বুকের ওপর রাখে। আমি মায়ায় পড়ে যাই। আমারই তো ঔরসজাত সন্তান। তখনই মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাচ্চাটিকে মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি,’ আমার দেশকে বলছিলেন হাবিবুর রহমান।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাটি কীভাবে বেড়ে উঠল তার বর্ণনা দেন হাবিবুর-জাহানারা দম্পতি। তারা জানান, ছয় বছর বয়সে লিতুনজিরাকে বাড়ির পাশে মসজিদ পরিচালিত মক্তবে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে অন্য বাচ্চারা হাত দিয়ে স্লেটে লিখত খড়িমাটি দিয়ে। কিন্তু লিতুনজিরার তো হাতই নেই। তাই সে মুখে চক ঢুকিয়ে লিখত। ক’দিন পর দেখা গেল, তার মুখে ঘা হয়ে গেছে।

মক্তবের হুজুর ওকে কাগজ-কলম ব্যবহারের সুযোগ দিলেন। এরপর মক্তবের পরীক্ষায় লিতুনজিরা প্রথম হলো। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (যাদের অধীনে মক্তব চলে) এক কর্মকর্তা এই খবর পেয়ে মক্তবে এলেন। তিনি বিশ্বাস করতে না পেরে পুনর্বার পরীক্ষায় বসালেন লিতুনজিরাকে। এবার আগের চেয়ে বেশি নম্বর পেল মেয়েটি।

মক্তবের পাঠ শেষ করে লিতুনজিরাকে ভর্তি করা হলো গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তার রোল নম্বর ছিল ১। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) সে শুধু জিপিএ-৫ই পায়নি, ইউনিয়নের মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। এর ফলে অর্জন করে সরকারি বৃত্তিও।

মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলো মণিরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মেধাতালিকায় স্থানও পেল। কিন্তু বেঁকে বসলেন প্রধান শিক্ষক হায়দার আলী। তিনি বললেন, তার স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস হবে দোতলায়। এই মেয়ে কীভাবে দোতলায় ওঠা-নামা করবে?

শুনে মন খারাপ হওয়া লিতুনজিরা নিজেই সিদ্ধান্ত দিল, ওই স্কুলে পড়বে না। বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় সে প্রথম স্থান অধিকার করল। এরপর দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াকালে সে কখনো দ্বিতীয় হয়নি।

ওই স্কুল থেকে মোট ৫১ জন শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। গত ১০ জুলাই প্রকাশিত এসএসসির ফলাফলে দেখা যায়, স্কুলটির ছয়জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার মধ্যে একমাত্র লিতুনজিরাই সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

কথা হয় লিতুনজিরার সঙ্গে। পাহাড়সম প্রতিকূলতা ঠেলে কীভাবে সে এগিয়ে চলেছে, মেয়েটি সেই গল্প শোনায় আমার দেশকে। তার বয়ানে, ‘পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। আমার চার হাত-পা নেই তো কী হয়েছে? মাথা তো আছে! বাবা-মা, শিক্ষক আর স্বজন-প্রতিবেশীরা সবাই আমাকে উৎসাহ দেয়।

তাদের উৎসাহে আমার ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয়েছে। আমি হারব না। দেখবেন, একদিন ডাক্তার হয়ে মানুষকে সেবা দেব। আপনারা দোয়া করবেন।’

বাবা হাবিবুর রহমান জানান, তার এই ‘অস্বাভাবিক’ মেয়ে শুধু লেখাপড়ায় নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সৃজনশীলতা দেখিয়েছে। মেধা যাচাই ও রচনা প্রতিযোগিতায় সে চারবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছ থেকে দুইবার স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছে। শিশু-কিশোরদের সংগঠন ‘আমরা করব জয়’-এর সদস্য হিসেবে সে খুলনা বেতারে নিয়মিত গান করে।

শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য তোমার পরামর্শ কী?- এমন প্রশ্নে লিতুনজিরার উত্তর, ‘কখনো ভেঙে পড়া যাবে না। সব সময় ভাবতে হবে, আমার দ্বারা কিছু হবে। অভিভাবকদেরও দায়িত্ব আছে। তারাও যেন এমন সন্তানদের সাহস দেন।’

লিতুনজিরার সাফল্যগাথা শুনে শুক্রবার মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত তামান্না তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি লিতুনজিরাকে মিষ্টিমুখ করান। উপজেলা প্রশাসন সব সময় তার পাশে থাকবে বলেও আশ্বাস দেন ইউএনও।

যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের অবহেলা না করে তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। লিতুনজিরা সবার অনুপ্রেরণা। উচ্চশিক্ষা পেতে মেয়েটির যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য সম্ভব সবকিছু করা হবে।

ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার রাজবংশী (এআর) কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হাবিবুর রহমান জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষক ও সংবাদকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘সবাই যেভাবে আমার মেয়ের পাশে আছেন, ভবিষ্যতেও তেমনটি থাকবেন বলে আশা করি। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে মেয়েটি বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রসঙ্গত, ‘লিতুনজিরা’ একটি আরবি শব্দ। পবিত্র কোরআনের সুরা ইয়াসিনের একটি আয়াতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ ‘যাতে আপনি সতর্ক করেন’। এই শব্দের অন্য অর্থ ‘আলো’ বা ‘স্বচ্ছতা’।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত