ভারতের পানির ঢলে বিপর্যস্ত উত্তরাঞ্চল, বাড়ছে নদীভাঙন

আমার দেশ ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৫৯
কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামে দুধকুমারের ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি। ছবি: আমার দেশ

ভারতের অবিবেচনাপ্রসূত পানি ব্যবস্থাপনায় আবারও বিপর্যস্ত হয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। দেখা দিয়েছে তিস্তা-যমুনা ও দুধকুমারের ভাঙন। নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। এই নদী ভাঙন রোধে নেয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ।

বিজ্ঞাপন

গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢল ও ভারতের অবিবেচনাপ্রসূত পানি ব্যবস্থাপনায় আবারও বিপর্যস্ত হয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। হঠাৎ করে তিস্তা নদীতে অস্বাভাবিক স্রোত ও পানি বৃদ্ধি বিপৎসীমার ওপরে চলে যায়, ফলে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় তলিয়ে যায়।

এক রাতের মধ্যে পানি নেমে গেলেও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙনের ক্ষতচিহ্ন। সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে গঙ্গাচড়ায় দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর রক্ষা বাঁধে, যেখানে প্রায় ৩০০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে দ্বিতীয় তিস্তা সেতু ও রংপুর-লালমনিরহাট আঞ্চলিক সড়ক, যেখান দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভারতের উত্তরবঙ্গের জলাধার থেকে একতরফাভাবে বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের নিম্নপ্রবাহে প্রবল ঢল নামে। এতে তিস্তার দুই পাড়ে ব্যাপক ভাঙন ও বন্যা দেখা দেয়।

গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ শাহিনুর ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০ হেক্টর আমন ধান, এক হেক্টর মাষকলাই, দুই হেক্টর বীজবাদাম ও শূন্য দশমিক পাঁচ হেক্টর সবজির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।

নোহালী ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছরই উত্তরাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে।

উপজেলা এলজিইডি শাহ মো. ওবায়দুল রহমান বলেন, ‘সেতু রক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে বিস্তারিত কাগজপত্র ও প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলেই জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারকাজ শুরু করা হবে।’

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, ‘উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টির কারণে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখন পানি কমছে। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।’ তিনি আরো জানান, ‘সোমবার বিকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সহযোগিতায় ২০ মেট্রিক টন চাল এবং দুই লাখ টাকা নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকরা অংশ নিয়েছেন।’ স্থানীয়দের একটাই দাবি, ‘আমরা ত্রাণ চাই না, চাই তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন।’

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দুধকুমার নদে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে কুড়িগ্রাম জেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রাম। সোমবার ভোর থেকে এ ভাঙন শুরু হয় গ্রামজুড়ে। সাতসকালে শান্ত দুধকুমার নদ আকস্মিক এমন রাক্ষসী রূপ ধারণ করায় চরম ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের মাঝে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকের গাছপালা, ভিটেমাটি বিলীন হয়ে গেছে।

ভাঙনরোধে নেওয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। ভাঙনের তীব্রতায় অন্তত অর্ধশত পরিবার হয়েছে বাস্তুহারা ও নিঃস্ব। তারা কোথায় যাবেন, পরিবার নিয়ে কীভাবে বসতি গাড়বেন—সেই চিন্তায় দিশাহারা। এখনো ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে আরো অর্ধশতাধিক পরিবার। বাড়িঘর ও আসবাবপত্র সরানোর কাজ করছে ভাঙনকবলিত মানুষ।

সোমবার বিকালে ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে আসেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি ভাঙনকবলিত পরিবারের তালিকা করে তাদের সহায়তার আশ্বাস দেন। সেইসঙ্গে ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান। তবে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা করা হবে কি না, সে ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি তিনি।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, টানাবর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়ে যাওয়ায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ভাঙনে উঠতি আমন ক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলি জমি ও বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হচ্ছে।

গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের উত্তর লালচামার গ্রামে ২০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ও ৫০টি বসতবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে এবং ২০০টি বসতবাড়ি ভাঙনের মুখে পড়েছে। পানি বাড়তে থাকায় নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। চরের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকা ছাড়া এক চর হতে অন্য চরে যাওয়া আসা করা সম্ভব হচ্ছে না।

উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। প্রতি বছর পানি বাড়লে বা কমলে, এমনকি বন্যা দেখা দিলেই শুরু হয় নদী ভাঙন। যে ভাঙন চলতে থাকে মাসের পর মাস।

নদীপাড়ের মানুষের অভিযোগ, সরকার স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধ, ড্রেজিং, নদীখনন ও সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি, হাজারও একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভাঙনকবলিত এলাকায় এই মুহূর্তে জিওব্যাগ ও জিওটিউব ফেলা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা হাতে নেই। স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধ সরকারের ওপর মহলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত