দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কালীগঞ্জের তিন নদী। এই নদী তিনটি হচ্ছে বেগবতী, চিত্রা ও বুড়ি ভৈরব।
জানা গেছে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই তিন নদী দখল, দূষণ ও পলি জমে এখন মৃতপ্রায়। একসময়কার প্রমত্তা নদীগুলো দখল করে গড়ে উঠেছে ভবন, দোকানপাট, পুকুর কিংবা আবাদি জমি। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত একই চিত্র—নদী দখলের দুঃসহ বাস্তবতা। শহরাঞ্চলে নদীর ওপর বহুতল ভবন ও মার্কেট এবং কালীগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত চিত্রা নদীর দুপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। নদীর বুক চিরে তৈরি হয়েছে পাকা ভবন, মার্কেট ও বসতবাড়ি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে নদী দখল করে রেখেছেন। প্রশাসন জানলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। শহরের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘নদীর চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। পিলার তুলে মার্কেট হয়েছে, পানি যাওয়ার পথ বন্ধ।’ কলেজছাত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘শুনেছি এখানে নৌকা চলত। এখন শুধু দখল আর বর্জ্য।’ শহরতলি বা গ্রামে নদী দখল করতে নতুন কৌশলে নদীর ভেতরে পুকুর ও গাছের বাগান করেছে এসব দখলদার। আবার কোথাও দেখা যায় আরো ভিন্নতর চিত্র। নদীর মাঝখানে পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
কোথাও নদীর চরে কলা, ইউক্যালিপটাস ও আমগাছ লাগিয়ে দাবি করা হচ্ছে ব্যক্তিগত জমি। আবার কোথাও নদীর পাড় দখল করে ইটের পিলারের ওপর দোকান বসিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাজার। বুড়ি ভৈরব নদীর পাড়ে চাষ করতে থাকা কৃষক আবদুল কাদের বলেন, ‘বছরের বেশি সময় নদী শুকিয়ে থাকে। খালি জমি পড়ে থাকে। গরিব মানুষ, তাই চাষাবাদ করছি।’ নদীতে ১২ মাস পানি না থাকায় মৎস্যজীবীদের জীবনে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। তাদের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে জড়িত। নদীতে পানি না থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, আর তাদের জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়েছে। বেগবতী নদীর ধারে জাল সেলাই করায় ব্যস্ত তৈলকূপী গ্রামের মৎস্যজীবী রিপন হোসেন বলেন, ‘আগে সকাল হলেই নদী থেকে মাছ ধরতাম। এখন নদীই নেই।’
কালীগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা হাসান সাজ্জাদ বলেন, ‘নদীগুলোয় দখল, দূষণ ও পলি জমে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে নদীগুলো দখলমুক্ত করে নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার না করলে দেশীয় মাছ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া নদীতে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট দেশীয় প্রজাতির মাছ শিকার যাতে কেউ না করতে পারে, সেজন্য আমরা খবর পেলেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘মৎস্য সপ্তাহ তখনই কার্যকর হবে, যখন নদী বাঁচবে। নদী না থাকলে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননও বন্ধ হয়ে যাবে।’
মানুষ বাঁচলেও নদী বাঁচছে না। নদী ছিল কালীগঞ্জের মৎস্যজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস। অথচ এখন নদীটি মৃতপ্রায়। নদীতে স্রোত নেই, নেই মাছ, নেই নৌযান; কেবল চোখে পড়ছে দখল আর অবহেলার চিহ্ন। কালীগঞ্জের এই তিন নদী আজ শেষ আশ্রয় খুঁজছে। দখলমুক্ত করা না হলে নদীগুলো শিগগিরই কাগজে-কলমে নাম হিসেবেই টিকে থাকবে।

