চট্টগ্রাম নগরে বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হচ্ছে মালিকদের। ভবনের পাইলিং, ঢালাই, টাইলস-প্লাস্টারের মতো প্রতিটি ধাপেই মেটাতে হচ্ছে একাধিক চক্রের দাবি। চাঁদা না দিলে হামলা, ভাঙচুর, এমনকি গুলিও করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। গত এক বছরে নগরের ১৬ থানায় এমন ১৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যার মধ্যে মামলা হয়েছে ৫৪টি। অনেক জায়গায় ভবনের মালিক চাঁদা দিতে পারেননি বলে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
নগরের ১৬ থানা থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে নগরের বিভিন্ন থানায় ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য চাঁদাবাজির অভিযোগ জমা পড়েছে ১৩৮টি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৫৪টি।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চান্দগাঁও এলাকায় দোকান ও ছোট ব্যবসাকে ঘিরে মাসোহারা সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয়। গত এক বছরে এখানে ২৩টি অভিযোগ ও ৯টি মামলা হয়েছে। হালিশহরে চাঁদাবাজির বড় অংশ পরিবহন ও ওয়ার্কশপকে ঘিরে। গত এক বছরে ১৭টি অভিযোগ ও ৬টি মামলা হয়েছে এ এলাকায়। বন্দর–ইপিজেড এলাকায় শ্রমিক পরিবহনকে কেন্দ্র করে নতুন করে চাঁদা তোলার প্রবণতা বেড়েছে। গত এক বছরে এখানে ১২টি অভিযোগ ও ৪টি মামলা হয়েছে। খুলশি–পাহাড়তলী–কাতালগঞ্জ এলাকায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির মুখোমুখি হতে হয়। এখানে ৩১টি অভিযোগ ও কয়েকটি মামলা হয়েছে গত এক বছরে। কোনো ভবনের ফাউন্ডেশন বা গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাজ শুরু হলেই ২-৩টি দল এসে চাঁদা দাবি করে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বাকলিয়া–ডবলমুরিং–কর্ণফুলী এলাকায়। এখানে গত এক বছরে ৩৭টি অভিযোগ ও অন্তত ৪টি মামলা হয়েছে। বাজারভিত্তিক মাসোহারা, দোকানে চাঁদা, সিএনজি–স্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড-সব ক্ষেত্রেই কয়েকটি প্রভাবশালী গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার করেছে।
তবে আমার দেশের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য। গত এক বছরে নগরে আরো অন্তত দেড় শতাধিক চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে কোনো ধরনের আইনি প্রতিকার চাইতে যাননি। ফলে এসব ঘটনা কার্যত আড়ালেই থেকে গেছে।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদা না দিলে কাজ এগোতে দেয় না চক্রগুলো। ফলে বাধ্য হয়েই চাঁদা দিতে হয়। অনেকেই এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দেন আবার কেউ কেউ পুনরায় হুমকির ভয়ে থানায় যান না। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যখন তখন চাঁদা দাবি করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর ইসলাম জানিয়েছেন, অবশ্যই সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে নগর পুলিশ হার্ডলাইনে রয়েছে। অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দিনদুপুরে গুলি, থেমে যায় ভবনের পাইলিং
নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কুয়াইশ রোডের উত্তরা হাউজিং এলাকায় ভবনের পাইলিংয়ের কাজ চলছিল ২৭ সেপ্টেম্বর, সকাল ৯টায়। হঠাৎ ১০-১২ জন যুবক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে নির্মাণস্থলে। একজনের হাতে পিস্তল, অন্যদের হাতে রামদা, কিরিচ, লোহার রড। ঢুকেই পিস্তলধারী পরপর চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তারপর তাদের নেতৃত্বে ভাঙচুর করা হয় নির্মাণসামগ্রী, মারধর করা হয় শ্রমিকদের। নিজেদের পরিচয় দেয় আলোচিত সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ও মোবারক হোসেন ইমনের লোক বলে।
ছোট সাজ্জাদ মূলত বর্তমানে বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ ১৭টি মামলা রয়েছে।
বায়েজিদ থানায় জহিরুল ইসলাম নামের একজন এই ঘটনায় পরদিন মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, উত্তরা হাউজিং এলাকায় ৬ কাঠার একটি প্লটে ২৪ জন ব্যক্তি একটি বহুতল ভবন তৈরির কাজ শুরু করেন চলতি মাসের ৫ সেপ্টেম্বর। কাজ শুরু করার কয়েকদিন পর ভবনটির প্রকৌশলী হাবিবকে হুমকি দেওয়া হয়। হুমকিদাতা নিজের পরিচয় দেন সন্ত্রাসী সাজ্জাদের সহযোগী ইমন বলে। দাবি করা হয়, ১৫ লাখ টাকা চাঁদা। চাঁদার টাকা না পেয়ে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। নির্মাণশ্রমিকদের মারধরও করেন তারা।
বায়েজিদ থানার চৌধুরী নগর এলাকায় ৯ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ী শামসুল হুদার ওপর হামলা চালায় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তাদের হাতে থাকা লোহার রড, রামদা ও লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলার পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয় শামসুল হুদার ব্যক্তিগত গাড়িটিও। স্থানীয়দের অভিযোগ, চৌধুরীনগর ও আশপাশে কিছুদিন ধরে নির্মাণকাজ, দোকান-ব্যবসা ও গাড়িচালকদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা দাবি করছে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। ভুক্তভোগীরা জানান, চাঁদা না দিলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া, মারধর বা ভাঙচুর—এটাই এখন চক্রটির নিয়মিত কৌশল।
বায়েজিদে শুধু গুলিবর্ষণ নয়, চাঁদা সংক্রান্ত বিরোধে গত ৫ নভেম্বর হত্যা করা হয় সরওয়ার হোসেন বাবলাকে। তাকে হত্যার পর ও আগে বিভিন্ন অডিওতে হত্যার কারণ চাঁদাসংক্রান্ত বলে উঠে আসে। এই এলাকায় গত এক বছরে অন্তত ১৫-২০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
জানতে চাইলে বায়েজিদ থানার ওসি মারেফুল করিম আমার দেশকে বলেন, বায়েজিদ এলাকায় আগে থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ কম আসছে। যেগুলো মামলা বা অভিযোগ এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
গত ১ আগস্ট চান্দগাঁও থানার উত্তর মোহরায় চাঁদা না দেওয়ায় এক ব্যবসায়ীর ঘরে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলায় গুলিবিদ্ধ হন ব্যবসায়ী ইউনূস। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উত্তর মোহরা এলাকায় সম্প্রতি চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে গেছে। নির্মাণকাজ থেকে দোকান-ব্যবসা-সব ক্ষেত্রেই চাঁদা দাবি করছে বিভিন্ন গ্রুপ।
জানা যায়, গত ২৩ জুলাই ওই ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বড় সাজ্জাদ। চাঁদা না দেওয়ায় তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায় সাজ্জাদের অনুসারীরা।
এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় শটগান হাতে ছোট সাজ্জাদসহ আরো দুজন গুলি করতে করতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে প্রবেশ করে সেখানে থাকা লোকদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। গত ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানা এলাকার শমশেরপাড়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৬) নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়।
এরপর গত ৩০ মার্চ রাতে নগরীর বাকলিয়ার এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে গুলি করে হত্যা করা হয় বখতিয়ার হোসেন ও আবদুল্লাহ নামের দুই ব্যক্তিকে। তারা ছিলেন সরওয়ার হোসেন বাবলার অনুসারী।
এই ঘটনাটিও চাঁদা সংক্রান্ত বলে জানিয়েছে পুলিশ। ৮ সেপ্টেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানাধীন শান্তিনগর এলাকায় ছুরিকাঘাতে শাহজাহান মিয়া ওরফে সাজন মিয়া (৩৫) নামে এক গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে চাঁদাবাজরা। তারা সাজন মিয়ার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল বলে স্থানীয়রা জানান।
চাঁদা না দিলে কাজ বন্ধ—একই অভিযোগ সব থানায়
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পাঁচলাইশ, আকবরশাহ, সাগরিকা, বাকলিয়া, খুলশী— সব জায়গা থেকেই একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও গাড়ি থেকে ইট ফেলতে চাঁদা, কোথাও বালু–সিমেন্ট আনলোডে চাঁদা, কোথাও দোকান তোলায় দিতে হচ্ছে চাঁদা।
বাড়ি নির্মাণে জড়িত ঠিকাদার, রাজমিস্ত্রি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন চক্র আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদা তোলে। পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকাও দাবি করে।
বায়েজিদ এলাকার ব্যবসায়ী নাঈমুল হক নামের একজন বলেন, বাড়ি তোলার মতো সাহস এখন কমে গেছে। খরচ তো বাড়ছেই, তার ওপর চাঁদা দিতে হয়। না দিলে হামলা করে ভেঙে দেওয়া হয় ভবন।
নির্মাণশ্রমিক রফিকুল বলেন, গুলির শব্দে আমরা দৌড়ে পালাই। ওরা বলে-চাঁদা দিয়ে কাজ করো। না দিলে কাজ বন্ধ।
শুধু হামলা নয়, ভয়ও নিয়ন্ত্রণের বড় অস্ত্র। বাকলিয়া এলাকায় কাজ করা এক ঠিকাদার বলেন, ‘কাজ শুরু করলেই ওরা খবর পায়। তারপর ফোন দেয়। টাকা না দিলে দা নিয়ে আসে। কাজ বন্ধ করে দেয়। এমনকি শ্রমিকরাও কাজ নিতে চায় না এই এলাকায়।’


সারা দেশের মতো রাজধানীতেও বাড়ছে শীত
কাজে আসছে না ৩৩৬ কোটি টাকার রূপপুর রেলস্টেশন
ভোটকেন্দ্র ও কক্ষের নিরাপত্তা সুরক্ষায় ইসির ১৫ চ্যালেঞ্জ