সাতকানিয়ার নুসরাত শারমিন হত্যাকাণ্ড

বিপ্লব বড়ুয়ার নির্দেশে চার্জশিট থেকে বাদ আসামিরা

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭: ০৫

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার গোয়াজরপাড়া গ্রামের নুসরাত শারমিন। ২০১২ সালে একই গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিমের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে তার ওপর চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। এরই মাঝে নুসরাতের কোলজুড়ে দুটি সন্তানের জন্ম হয়। দাবি আরও বাড়তে থাকে স্বামী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে। বাবা দরিদ্র হওয়ায় মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করতেন নুসরাত। তবে নির্যাতনের সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। এদিন দুই শিশু সন্তানের সামনে তাদের মাকে নৃশংস নির্যাতনের পর কুপিয়ে হত্যা করে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।

নুসরাতকে যেদিন কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেদিন তার বড় সন্তানের বয়স ছিল এক বছর, আর ছোটটির তিন মাস। স্বামী রোয়াংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাতকানিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়ার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিপ্লব বড়ুয়ার প্রভাবেই চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটি এতদিন ধামাচাপা পড়ে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নিহত নুসরাতের ভাই মোহাম্মদ নাছিম জানান, বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে তার বোনের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাত স্বামীসহ তার পরিবার। একপর্যায়ে নির্যাতন সইতে না পেরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তাদের বাড়িতে চলে আসেন তার বোন। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়ার ঢেমশা ইউনিয়নে একটি ভাড়া বাসায় নুসরাতকে ডাকেন স্বামীর ছোট বোন রোকেয়া বেগম। ওইদিন দুপুরেই নুসরাত তার ছোট ভাইকে নিয়ে ননদের বাড়িতে যান। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে নুসরাতের ভাই ফিরে আসেন। এর পরপরই সেখানে আসেন আব্দুর রহিম। চড়াও হন নুসরাতের ওপর। বোন রোকেয়া বেগম, ভাই মোস্তাক আহমেদও আব্দুর রহমানের সঙ্গে একাট্টা হয়ে মারধর করতে থাকেন নুসরাতকে। এক পর্যায়ে ঘরে থাকা দা দিয়ে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে আব্দুর রহিম। মেডিকেল প্রতিবেদনে বলা হয়, নুসরাতের মাথায় চারটি কোপের অস্তিত্ব মিলেছে, যার সবই কমপক্ষে দুই ইঞ্চির বেশি গভীর ছিল। শরীরেও ছিল অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন।

ঘটনার পরের দিন নুসরাতের ভাই মো. নাছিম বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। সেখানে স্বামী আব্দুর রহিমকে প্রধান আসামি করে ভাই আব্দুল জলিল, আব্দুল সামাদ, মোস্তাক আহমেদ, বোন রোকেয়া বেগম ও হোসনে আরা পারভীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু থানা-পুলিশ মামলা নেয় শুধু আব্দুর রহিমকে আসামি করে।

পরে ২০২০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম আদালতে যান বাদী মো. নাছিম। আদালত বাকি ৫ আসামিকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। বিপ্লব বড়ুয়ার নির্দেশে থানা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ৫ আসামির নাম বাদ দিয়ে দেয়। পরে বাদী নাছিম ২০২২ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে রিভিশন আবেদন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়।

পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিল আলামত জব্দ করা, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি অনুযায়ী ভুক্তভোগী নুসরাতকে আব্দুর রহিম মারার পর তার ভাই মোস্তাককে ডেকে নিয়ে আসেন তখন অন্য আসামিরা ঘটনাস্থলে ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলে, এমন আঘাতের পর ভুক্তভোগী নুসরাত চিৎকার করেন। কিন্তু আসামিরা নুসরাতকে বাঁচাতে যায়নি। বরং স্বামী আব্দুর রহিমকে সহযোগিতা করেন। এমনকি নসুরাতকে তালাবদ্ধ ঘরে আটকে রাখেন। সেই তালাটিও আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়নি, যা নৃশংস হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

আদালত সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তের দায়িত্ব পান পরিদর্শক উস্তার মিয়া। কিন্তু সিআইডি আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুসরণ না করে আসামিদের বাদ দিয়ে মামলার চার্জশিট দেয়। মামলার বাদী নাছিমের অভিযোগ, আব্দুর রহিমের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় সব জায়গা থেকে নাম বাদ দিতে জোর তদ্বির চালান বিপ্লব বড়ুয়া। এমনকি তাকেও ফোন করে মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকিও দেন ওই সময়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা।

মামলার বাদী নাছিম বলেন, সিআইডি তদন্ত করার সময় বাদীর কোনো বক্তব্য নেয়নি। এমনকি চার্জশিট দেওয়ার সময় তাকে জানানো তো দূরের কথা তার স্বাক্ষর জাল করে লিখিত জবানবন্দি জমা দিয়েছে সিআইডি। তারা যাদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নিয়েছে তারা সবাই অভিযুক্ত পরিবারের। নাছিম আক্ষেপ করে বলেন, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। দেশে নতুন সরকার এসেছে। আমরা সঠিক বিচার চাই। আমার বোনের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক উস্তার মিয়া আমার দেশকে বলেন, জবানবন্দি অনুযায়ী মামলার আসামিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদীসহ ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কারও কথায় তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।

এমএস

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত