জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি আজ

শুরু হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজ

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২৯

সমুদ্র বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বদলে দিতে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। আগে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার বন্দর হয়ে অথবা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে। অন্যদিকে সাড়ে ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটের মাদার ভেসেলের প্রবেশাধিকার নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। তাই বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বহু দিনের দাবি রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

এবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে মাতারবাড়িতে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৈরি করা নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পেরিয়ে এবার নির্মাণ পর্বে প্রবেশ করতে চলেছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। গভীর এ সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজ শুরুর জন্য আজ মঙ্গলবার ঢাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাপানের নির্মাণ কোম্পানি পেন্টা ওশান কনস্ট্রাকশন ও টিওএ করপোরেশনের মধ্যে যৌথ নির্মাণ চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাতা-কলমে সমুদ্র বন্দর বলা হলেও চট্টগ্রাম বন্দর মূলত নদীবন্দর। সমুদ্রের মোহনায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই বন্দরটি জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল। দিনে দুবার ৬ ঘণ্টারও কম সময় ভরা জোয়ারে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটারের জাহাজ চলাচল করতে পারে এই বন্দরের চ্যানেলে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে অবশ্য এই সীমাবদ্ধতা কেটে যাবে। সেখানে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে অনায়াসে। কিন্তু এসব সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে মাতারবাড়ি। কারণ এই বন্দরে সরাসরি নোঙর করতে পারবে ১৭ মিটার ড্রাফটের মাদার ভেসেল, যেগুলোর ধারণক্ষমতা ৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনারের মতো। এই একটি সমীকরণই বদলে দেবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ।

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল ইসলাম সুজন জানান, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি কন্টেইনার সিঙ্গাপুর কিংবা কলম্বো বন্দরের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৪২ দিন। ২০ ফিটের একটি কন্টেইনারে খরচ হয় গড়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২শ’ ডলার। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে সরাসরি মাদার ভেসেলগুলো ভিড়তে পারলে সময় লাগবে দুই সপ্তাহের কম। আর একটি কন্টেইনারে খরচ হবে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩শ’ ডলারেরও কম। যার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।

মহেশখালীর পরিত্যক্ত চর ছিল মাতারবাড়ি। এই চরে গড়ে ওঠে ১ হাজার ২শ’ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয় ১৭ মিটার ড্রাফটের ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটারের কৃত্রিম চ্যানেল। সাগরের বুকে প্রথমবারের মতো তৈরি করা হয় ব্রেক ওয়াটার। এই চ্যানেলেই উঁকি দেয় নতুন বন্দর নির্মাণের স্বপ্ন। এবার চ্যানেলকেই আরেকটু সংস্কার করে তৈরি করা হচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। ইতিমধ্যে চ্যানেলটিতে মোট ১৬১টি জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, মাতারবাড়ি বন্দর অপারেশনে এলে দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। কারণ ব্যবসায়ীরা সময় ও টাকা যেখানে কম লাগবে সেখানেই বাণিজ্য করতে উৎসাহিত হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও চায়নার একাংশের আমদানি এবং রপ্তানিকারকরা মাতারবাড়ি বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন। কারণ সিঙ্গাপুর ও কলম্বো থেকে মাতারবাড়ি বন্দর ব্যবহারে তাদের সময় ও খরচ দুইই সাশ্রয় হবে। বিপরীতে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান জানান, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক। আজ মঙ্গলবার জাপানের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু হবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ। বন্দরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ব্রেক ওয়াটার তৈরি আর চ্যানেল খনন। এই দুটি কাজই বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সময় করা হয়ে গেছে। তাই মাতারবাড়ি বন্দর তৈরিতে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই এখন। আশা করা হচ্ছে ২০২৯ সালের মধ্যেই অপারেশন কাজ শুরুর মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দরের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত