স্বাধীনতার পর এই প্রথম মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে নিরাপদ যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছে দ্বীপের মানুষ। এতদিন যা ছিল শুধু স্বপ্ন এখন তা বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। হাতিয়ায় সরাসরি গাড়ি চলাচল করবে । এর ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ফেরি চলাচলের সিদ্ধান্তে বদলে যাবে দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন। দুই পাড়ে শুরু হয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু হবে ফেরি। সেই অপেক্ষায় রয়েছে নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বাসিন্দারা।
একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়নের এ দ্বীপে সাড়ে সাত লাখ লোকের বসবাস। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌ-যোগাযোগ। দীর্ঘদিন থেকে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সি-ট্রাক ও ট্রলারে নদী পারাপার করতে হতো, ছিল চরম ভোগান্তি। পুরাতন সি-ট্রাকগুলো প্রায় সময় বিকল হয়ে পড়ে থাকত ঘাটে। তাতে ঝুঁকি নিয়ে ছোট ট্রলার ও স্পিডবোটে নদী পার হতো যাত্রীরা। মালামাল আনা-নেওয়াতে ছিল ভোগান্তি। নিরাপদ যোগাযোগ ছিল দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বপ্ন। বিগত সরকারগুলো শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ ছিল। উল্লেখ করার মতো কোনো উন্নয়ন যোগাযোগ ব্যবস্থা করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল আনা-নেওয়া করত ট্রলারে। বর্ষায় প্রতিকূল আবহাওয়ায় সেই ট্রলারডুবির ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্যবার।
ফেরি চলাচলের জন্য নলচিরা ও চেয়ারম্যান ঘাটে লেন্ডিং স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে।
নলচিরা ঘাটে দেখা হয় স্থানীয় আফাজিয়া বারের ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি জানান, প্রতিদিন একবার ঘাটে আসেন ফেরি চলাচলের কাজ দেখার জন্য। নিজের চোখে ফেরি চলাচল দেখতে পাবেন যা কখনো চিন্তাও করেননি তিনি। প্রায় শতাধিক শ্রমিক রাত-দিন কাজ করায় খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দুই পাড়ের ল্যান্ডিং স্টেশনের কাজ। মাঝেমধ্যে জোয়ার-ভাটার কারণে কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তাসহ অনেক কাজ দৃশ্যমান হয়েছে।
হাতিয়া দ্বীপ নিউমার্কেটর ব্যবসায়ী আশিক ইকবাল জানান, ফেরি চলাচলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে দ্বীপের ব্যবসায়ীরা। তাদের মালামাল বোঝাই গাড়ি কম খরচে সরাসরি দোকানের সামনে চলে আসবে। দ্বীপের বাসিন্দারা সুলভমূল্যে পণ্য কিনতে পারবে। এক সময় ব্যবসায়ীরা ট্রলারবোঝাই করে ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম চাঁদপুর থেকে মালামাল ক্রয় করে আনতেন হাতিয়ায়। এতে মালামাল নিয়ে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার।
স্থানীয় বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অনেক গর্ভবতী মাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নদী তীরে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বর্ষা মৌসুমে যখন নদী উত্তাল ও সতর্ক সংকেত দেওয়ার পর নৌ-চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে। কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষার আগের দিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন দ্বীপের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী ঘাটে আটকা পড়ে। ফেরি চালু হলে এ সমস্যায় আর পড়তে হবে না। একেবারে বেশি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া না হলে নিরাপদে ফেরি চলাচল করতে পারবে।
ফেরি চলাচলে উচ্ছ্বসিত দ্বীপের বাসিন্দারা। এ রুটে চলাচলকারী যাত্রী, মুমূর্ষু রোগী, পণ্য আনা-নেওয়া ও জরুরি প্রয়োজনে জেলা শহরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখন আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না। ব্যবসায়ীদের মালামাল বোঝাই গাড়ি আসবে দোকানের সামনে। থাকবে না কোনো ঝুঁকি। আবার দ্বীপের উৎপাদিত ফসল, ঢাল, বাদাম, ধান ও ইলিশ মাছসহ ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া যাবে মোকামে। এ ফেরিতে দ্বীপের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি যেমন দূর হবে তেমনি অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এএসএম আশ্রাফুজ্জামান বলেন, দ্রুত ফেরি চলাচলের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আপাতত দুই পাড়ে লো-ওয়াটার ও মিড-ওয়াটার চারটি রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এতে জোয়ারে ও ভাটিতে ফেরি থেকে গাড়ি উঠা-নামা করতে পারবে। এছাড়া দুই পাড়ে জেটি, যাত্রী ছাউনি, ফেরিঘাট, ব্যাংক প্রটেকশন, ফেরিঘাট এপ্রোচ রোডসহ আরো কিছু কাজের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে এসব কাজও দ্রুত করা হবে।

