জুলাই গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত সোমবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দেশবাসী যখন উচ্ছ্বসিত— ঠিক তখনই চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া সেল হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছে। যদিও ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় এই স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান।
হাজার হাজার ছাত্র-জনতার হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের দেড় বছর পর নতুন করে তার পদত্যাগ চেয়ে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠছে সীতাকুণ্ডে ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া সেল। এ ছাড়াও কাজী সালাউদ্দিনের কথায় নিয়ন্ত্রিত সীতাকুণ্ড বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে আমার দেশ পত্রিকার ভুয়া ফটোকার্ড তৈরি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি গুজবও ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যা নিয়ে উপজেলাজুড়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
গত সোমবার রাতে আমার দেশ পত্রিকার ভুয়া ফটোকার্ড তৈরি করে সীতাকুণ্ড বিএনপি মিডিয়া সেল নামে একটি পেজ থেকে পোস্ট করা হয়। ওই পোস্টে লেখাছিল- ‘সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম ৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের সম্ভাবনার নাই’, বিস্তারিত কমেন্টে, এভাবে ফটোকার্ড ছড়ানো হয়। যা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান সীতাকুণ্ডের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। পরে আমার দেশ-এর ফেসুবক পেজ ওই ফটোকার্ডটি ভুয়া উল্লেখ করে প্রচার করা হলে নেতাকর্মীদের এবং পাঠকদের বিভ্রান্তি কেটে যায়। এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে কাজী সালাউদ্দিনে তৈরি ধানের শীষের মিডিয়া সেল গ্রুপের পরিচালক ও টিম লিডার সাবেক শিবির নেতা সরোয়ার হোসাইন লাভলু ধানের শীষের মিডিয়া সেল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পোস্ট করেন। এতে লেখা হয়, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিনের সমর্থনে পৌর এলাকায় একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিক্ষোভ মিছিল থেকে স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন পৌরসভা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক একে এম শামসুল আলম।’
এতে আরো বলা হয়, ‘দেশবাসী হাসিনার দু:শাসনের জাঁতাকলে অতিষ্ঠ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ নিঃশেষ। শেখ হাসিনার দুঃশাসনে জনগণ দমবন্ধ অবস্থায় জীবনযাপন করছে। বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীকে গুম, খুন ও কারাগারে পাঠিয়ে দেশকে এক ব্যক্তির দাসত্বে পরিণত করা হয়েছে। আমরা সেই অবিচারের বিচার চাই।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘জুলাই আগস্ট বিপ্লবে শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে না। শীঘ্রই দুঃশাসনের অবসান ঘটবে। পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করা হয়।’
কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া সেল থেকে এমন হাস্যকর বিবৃতি পাঠানোর পর উপজেলা জুড়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। সচেতন মহল বলছে, একজন সংসদ সদস্য প্রার্থীর মিডিয়া সেলের প্রধান করা হয়েছে শিবিরের সাবেক নেতা ও বিতর্কিত ব্যক্তি সরোয়ার হোসাইন লাভলুকে৷ এনিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক জহুরুল আলম জহুর বলেন, তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করে কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিনের পাশে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মী নেই। যার কারণে সাবেক শিবির নেতাকে মিডিয়া সেলের দায়িত্ব দিয়েছে যা তার চরম রাজনৈতিক দেওয়ালিত্ব। এরপর তার বরাতে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দু:শাসনের অবসান চান বলে৷ যা দলের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ও মানহানিকর। তিনি আরও বলেন, সবাই জানে তার পক্ষে দুটি পেজ খোলা হয়েছে। একটি ধানের শীষের মিডিয়া সেল ও অন্যটি সীতাকুণ্ড বিএনপি মিডিয়া সেল। একজন প্রার্থীর পেজ থেকে এভাবে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় প্রথম সারির পত্রিকা আমার দেশ-এর ভুয়া ফটোকার্ড বানিয়ে গুজব ছড়ানো অত্যন্ত দুঃখজনক।
পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাহের উদ্দিন আশরাফ বলেন, বিএনপির মতো বৃহৎ একটি দলের যেখানে হাজার হাজার নেতাকর্মী রয়েছে, সেখানে সাবেক শিবিরের একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। ধানের শীষের মিডিয়া সেল থেকে যিনি ওই হাস্যকর বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন সম্ভবত তিনি মঙ্গলগ্রহে রয়েছেন। তা না হলে যেখানে পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন স্বদল বলে। সেখানে একজন বিএনপি নেতার মিডিয়া সেল থেকে হাসিনার পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে। অথচ সেই গ্রুপে কাজী সালাউদ্দিন ও আছেন। তার এমন কাণ্ডে পুরো সীতাকুণ্ডে বিএনপি হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে।
উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোরশেদ আলম সোহাগ বলেন, সীতাকুণ্ড বিএনপি মিডিয়া সেল সাবেক শিবির নেতা সরোয়ার লাভলুসহ কয়েকজন চালাচ্ছে। লাভলু বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করে দলের ভিতরে ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্রদল নেতা বলেন, প্রায় সময় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে ভিডিও, ছবি বানানোর পাশাপাশি প্রেস বিজ্ঞপ্তি লিখছেন কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া ছেলের টিম লিডার সরোয়ার হোসাইন লাভলু। নিজস্ব কোন জ্ঞানগর্ভ না থাকাই তিনি এআইয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ফলে কি লিখছেন তা নিজেও জানেন না।
এর আগে সরোয়ার লাভলুকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয় সীতাকুণ্ড উপজেলা জুড়ে। জামায়াত নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাথী ও ২০০৩ সালে পৌরসভা শিবিরের সাবেক সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চাইলে শিবিরের সাবেক নেতা হওয়ায় তাকে আওয়ামী লীগের সদস্য করা হয়নি৷ পরে তিনি বিএনপির কতিপয় নেতাদের হাত ধরে দলে অনুপ্রবেশ করেন। তার বিরুদ্ধে পৌরসভা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুর আলম আজাদের স্বাক্ষর জাল করে কমিটিতে যুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও দিশারী যুব ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দুরন্ত পথিক আদর্শ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে দুটি সংগঠন হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও আছে লাভলুর বিরুদ্ধে। তিনি উপজেলা মহিলা লীগের সভানেত্রী সুরাইয়া বাকেরকে কেক খাইয়ে ও নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায় করে। তার দুই সংগঠনেও অধিকাংশই শিবির ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রয়েছেন।
সীতাকুণ্ডের তাহের মনজুর ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের নেতা, সরোয়ার উদ্দিন নিরব দিশারী যুব ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় উন্নয়ন পর্যবেক্ষক। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানীর অনুসারী। সরোয়ার হোসাইন লাভলুর বিরুদ্ধে আছে অর্থের বিনিময়ে নগরের লালখান বাজার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় ১ লাখ টাকার বিনিময়ে জাতীয় যুব দিবস-২০২৩ এর অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠক হিসেবে পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ৷
অভিযোগ উঠেছে, তৎকালীন লালখান বাজার জোনের যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জাহান উদ্দিনকে ম্যানেজ করে কোন ধরনের যুব উন্নয়নমূলক কাজ না করার পরও সরোয়ার হোসাইন লাভলু পুরস্কার হাতিয়ে নেন৷ সেসময় যুবদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
যুব সংগঠক মিনহাজ উদ্দিন জানান, সরোয়ার লাভলু হঠাৎ করে ২০২৩ সালে শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠক পুরস্কার পান। আমরা তাকে সেবার প্রথম চিনি। এর আগে যুব সংগঠক হিসেবে তাকে কেউ চিনতো না।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরোয়ার হোসাইন লাভলু কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া সেল থেকে গুজব ছড়ানোর কারণে বর্তমানে উপহাসে রূপ নিয়েছে সীতাকুণ্ড ধানের শীষ মিডিয়া সেল। তিনি বলেন, কাজী সালাউদ্দিনের মিডিয়া সেলের প্রধান সেহেতু এসব ভুয়া ফটোকার্ড তিনিই ছড়াচ্ছেন। তিনি রাতারাতি পেজ খুলে ডলার দিয়ে কয়েক হাজার লাইক, ফলোয়ার কিনে ফেলছেন। যা রীতিমতো হাস্যকর।

