চট্টগ্রামে ছয় মাসে ৩৫৮৫ অগ্নিকাণ্ড

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অপ্রতুল পানির উৎসে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩৪

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গত ছয় মাসে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন হাজার ৫৮৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সব ঘটনায় কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

বিজ্ঞাপন

ফায়ার সার্ভিসের দাবি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানির পর্যাপ্ত উৎসের অভাব এবং সমন্বয়হীনতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে বন্দর, বিমানবন্দর, ইপিজেড ও জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলে আগুন নেভাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ, এসব স্থানে আগুন লাগার খবর অনেক সময় দেরিতে পৌঁছায় আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ফায়ার ফাইটার থাকলেও মূল ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তাদের সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় আগুন দ্রুত ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

গত ১৬ অক্টোবর দুপুরে চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আটতলার গুদামে লাগা আগুন প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও আগুন দ্রুত পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। টানা ১৭ ঘণ্টা জ্বলে ভবনটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ৪৮ ঘণ্টা পর আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস।

এর আগে ২০২৪ সালের ৪ মার্চ আনোয়ারার ইছানগরে এস আলম গ্রুপের চিনির কারখানায় আগুন লাগে। পাঁচদিন ধরে জ্বলা ওই আগুনে গুদামে থাকা এক লাখ টন চিনি পুড়ে যায় বলে দাবি করে কর্তৃপক্ষ। সেবারও পুরো গুদামের সবকিছু জ্বলেপুড়ে নিজ থেকেই নিভে যায়।

তারও আগে ২০২২ সালের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রপ্তানিমুখী একটি কনটেইনারে থাকা অক্সিজেন পার অক্সাইড নামে কেমিক্যালেও আগুন লাগে। ওই কনটেইনারে বিস্ফোরণ ঘটলে আগুনের ভয়াবহতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। তিনদিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে ফায়ার সার্ভিসের ১০ কর্মীসহ নিহত হন ৫১ জন। আহত হন শতাধিক মানুষ।

ওই সব ঘটনার পর আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন টার্নটেবল ল্যাডার, স্কাই লিফট, স্নোর্কেল ও লুফ-সিক্সটি রোবট সংযোজন করা হলেও বড় অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসকে এখনো দুর্বল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশনের উপপরিচালক জসিম উদ্দিন জানান, গত ছয় মাসে আমরা ছোট-বড় সাড়ে তিন হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগুন ছোট পরিসরে নিয়ন্ত্রণে এলেও বন্দর ও ইপিজেড এলাকার মতো সংবেদনশীল স্থানের খবর দেরিতে আসায় আগুন বড় আকার ধারণ করছে।

তিনি আরো বলেন, অনেক কারণেই অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এগুলোর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে খবর আসছে না। কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রথমে নিজেরাই আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হয়ে যখন ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগুন অনেক বড় আকার ধারণ করে। আবার বন্দর, ইপিজেড ও এয়ারপোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজস্ব ফায়ার ফাইটার থাকলেও তাদের সঙ্গে মূল ফায়ার সার্ভিসের কোনো সমন্বয় নেই।

ফায়ার সার্ভিসের ইকুইপমেন্টগুলো যথাসময়ে মেইনটেন্যান্স করা হলেও ওই সব প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতিগুলো সেভাবে মেইনটেন্যান্স করা হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক যন্ত্রাংশই যথাসময়ে কাজ করে না। আগুন বড় আকার ধারণ করে। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে আগুন ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো। ইপিজেডসহ বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সে লক্ষ্যেই কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস।

নগর পরিকল্পনায় ত্রুটি

নগরবিদ স্থপতি আশিক ইমরান মনে করেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও পানির উৎস ধ্বংস হওয়াই অগ্নিকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের সময় চারপাশে ফাঁকা জায়গা রাখার নিয়ম কেউ মানছে না। পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি সংগ্রহ করতেও সময় লাগছে। এতে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ ইছা আনসারী জানান, ১০ তলার উপর ভবন নির্মাণে চারপাশে ন্যূনতম পাঁচ ফুট খালি জায়গা রাখার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ভবনেই তা মানা হয় না। প্রতিটি হাইরাইজ ভবনে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন (এনওসি) ও অগ্নিনির্বাপণ সুবিধা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না। জনবল সংকটসহ নানান কারণে সিডিএ এসব বিষয়ে তদারক করতে পারে না।

ওয়াসার সব ফায়ার হাইড্রেন্ট অকেজো

২০১৮ সালে জাইকার অর্থায়নে চার কোটি ১০ লাখ টাকায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে ওয়াসা। প্রতিশ্রুতি ছিল প্রতিটি হাইড্রেন্টে উচ্চচাপের পানি সরবরাহ থাকবে। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিতেই পানি পাওয়া যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জসিম উদ্দিন জানান, ওয়াসার পক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কাছে চাহিদা চাওয়া হয়েছিল। আমরা ২২৯টি হাইড্রেন্টের চাহিদা জানিয়েছিলাম। তার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসা ১৭৪টি হাইড্রেন্ট স্থাপন করলেও সেগুলো কার্যকর হয়নি। এ কারণে অনেক সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বিলম্ব হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত