নাজুক আইনশৃঙ্খলায় রাউজানে রাজত্ব অস্ত্রবাজদের

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৫: ৫৬

চট্টগ্রামের রাউজান যেন এক ‘মিনি যুদ্ধক্ষেত্র’। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চলছে সশস্ত্র মহড়া, গুলি। গত ১১ মাসে অন্তত ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এ উপজেলায়। আহত হয়েছেন অনেকে। বালুমহাল, ইটভাটা, কাঠ চোরাচালান, মাদক পাচারসহ ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ এর মূল কারণ । আগে আওয়ামীপন্থি সন্ত্রাসীদের দ্বারা এসব সংঘটিত হলেও বর্তমানে বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, যুবলীগ নেতা আজিজ উদ্দিন ইমুর সহযোগী রায়হানের নেতৃত্বে চলছে এসব হত্যাকাণ্ড ।

স্থানীয়রা বলছেন, রাউজান এখন একটি ‘অস্ত্রের খামার’। সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে। লোকজনকে টার্গেট করে গুলি করছে। পাহাড় সংলগ্ন এলাকা হওয়ায় পুলিশ অভিযান চালালেও গহিন পাহাড়ে লুকিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীর প্রধান বাহন সিএনজি অটোরিকশা। এসব খুনের মধ্যে অন্তত চারটি সিএনজি অটোরিকশা চেপে কখনো কখনো যাত্রীবেশে বোরকা পরে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা।

বিজ্ঞাপন

সবশেষ গত ৬ জুলাই দুপুরে রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের ইশানভট্ট বাজারে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা মুহাম্মদ সেলিমকে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, একটি সিএনজি অটোরিকশা থামার পর একে একে নামে সাত সন্ত্রাসী। এদের কেউ টি-শার্ট-জিন্সে, কেউবা বোরকার আড়ালে। মাত্র ছয় মিনিটে তারা খুন করে পালিয়ে যায়। পুলিশের ধারণা, এরা ছিল রায়হান বাহিনীর সদস্য।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল পূর্ব রাউজানের গাজীপাড়া এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী মো. ইব্রাহিমকে। তিনটি সিএনজিযোগে অন্তত ১২ অস্ত্রধারী ঘটনাস্থলে আসে। মাথা ও বুকে গুলি করে ইব্রাহিমকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

এর মাত্র দুদিন আগে ২০ এপ্রিল বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে ভাত খাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী মানিক আবদুল্লাহকে। তার স্ত্রী জানান, ওরা দরজা ভেঙে ঢুকে মুখে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়।

অস্ত্রের উৎস পাহাড়, সন্ত্রাসীর নাম রায়হান

একের পর এক এ ধরনের খুনের পেছনে উঠে এসেছে একটি নামÑরায়হান। রায়হান চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগ নেতা আজিজ উদ্দিন ইমুর দীর্ঘদিনের সহযোগী। আজিজ বাহিনীকে অস্ত্রের জোগান দেওয়া ও খুনের পরিকল্পনায় সহযোগিতাকারী হিসেবেই পরিচিত সে। আজিজকে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর থেকেই রায়হান হয়ে ওঠে আরো বেপরোয়া।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রায়হান এখন একাই নিয়ন্ত্রণ করছে অস্ত্র সরবরাহ, বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া ও অপারেশন। তাকে একাধিকবার ধরতে অভিযান চালানো হলেও ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ, সে আত্মগোপনে আছে রাউজানের গহিন পাহাড়ে, যেখানে পুলিশেরও প্রবেশাধিকার নেই। কারণ, পাহাড়ি ওই এলাকাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ।

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, রায়হানই এখন মূল টার্গেট। আমরা তাকে এক মাসের বেশি সময় ধরে ট্র্যাক করছি। কিন্তু অভিযান চালালেই সে পাহাড়ে পালিয়ে যায়। পাহাড়ে অভিযানে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, পাহাড় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত জনপদ

রাউজানে সহিংসতা কেবল আওয়ামী লীগপন্থি সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও এখানে রক্ত ঝরছে। উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দ্বন্দ্ব এখন রূপ নিয়েছে সংঘাত আর হত্যাকাণ্ডে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং উত্তর জেলা আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার অনুসারীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গত এক বছরে অন্তত ছয়জন নিহত হন। বাকিরা কেউ আওয়ামী লীগের কর্মী; আবার কারো কারো রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি।

এ ছয় হত্যাকাণ্ডই বিএনপির দুটি শক্তিধর অংশ গিয়াস ও আকবর অনুসারীদের মধ্যকার তীব্র বিরোধের ফল বলে দাবি করেছেন স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। তবে উভয় পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে।

২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট রাউজান পৌরসভার চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালীর শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে লাঠি ও রড দিয়ে আঘাত করে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলে রেখে যায়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর উদ্ধার করা হয় মো. ইউসুফ নামে এক যুবকের লাশ। পরিবারের অভিযোগ, ইউসুফ নিখোঁজ ছিল তিন দিন ধরে। তার শরীরে ছিল নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন।

১১ নভেম্বর নিখোঁজ থাকা মাদরাসা শিক্ষক আবু তাহেরের লাশ ভেসে ওঠে রাউজানের সর্তাখাল খালে। স্থানীয়ভাবে তিনি পরিচিত ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে। হত্যার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক থাকলেও এখনো তা তদন্তাধীন। ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি নোয়াপাড়া এলাকায় জুমার নামাজে যাওয়ার সময় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে। তার স্ত্রী অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক বিরোধের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়।

১৫ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে খুন হন যুবদলকর্মী কমর উদ্দিন জিতু। তিনি ছিলেন গিয়াস কাদেরের অনুসারী। আকবরপন্থি নেতাকর্মীরা তার পোস্টকে ‘উসকানিমূলক’ আখ্যা দিয়ে রাতের বেলায় তাকে অপহরণ করে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২১ মার্চ পূর্ব গুজরায় গণপিটুনিতে মারা যান মো. রুবেল নামে এক যুবক। স্থানীয়ভাবে প্রচার করা হয় রুবেল গরু চোর হিসেবে ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে উঠে আসে রুবেল ছিলেন যুবদলকর্মী এবং রাজনৈতিক পরিচয়কে কেন্দ্র করেই পরিকল্পিতভাবে তাকে টার্গেট করা হয়।

এ বিষয়ে গিয়াস কাদের চৌধুরী বলেন, মানিক, ইব্রাহিম, জিতুÑএ তিনজনকেই প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের কাছে ভিডিও প্রমাণ আছে। কিন্তু মামলার তদন্তে বাধা দিচ্ছে প্রভাবশালী মহল।

অন্যদিকে গোলাম আকবর খন্দকারের ভাষ্য, যারা খুন-চাঁদাবাজিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

তবে প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, এসব মামলায় তদন্তের সময় রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হয় উভয় পক্ষ থেকেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্তকাজে অগ্রগতি হয় না।

সন্ধ্যা মানেই আতঙ্ক, রাত মানেই শোক

রাউজানে এখন সূর্য ডোবার আগেই নেমে আসে ভয়। সন্ধ্যা হতে না হতেই জনপদ নীরব হয়ে পড়ে। বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই। অনেক ঘরেই তখন আলো নিভিয়ে টিভির শব্দ পর্যন্ত বন্ধ করে ফেলা হয়। যেন চারপাশে শুধু অপেক্ষা গুলির শব্দ, একটি চিৎকার, একটি মৃত্যুর খবরের।

পূর্ব গুজরার মুদি দোকানি আবদুল জলিল বলেন, বিকাল থেকেই মনে হয় আজ আবার কারো লাশ পড়বে। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি আলো নড়ল কি না, কেউ নামছে কি না। গুলির শব্দ শোনা গেলেই দোকান বন্ধ করে ফেলি।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক নাজমা আক্তার বলেন, শিশুদের স্কুলে পাঠাতে ভয় লাগে। তারা জিজ্ঞেস করে, মা বাইরে গেলে গুলি করবে না তো? আমরা উত্তর দিতে পারি না।

রাউজান থানা এলাকার একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা জানি কোথায় কারা থাকে, কারা কী করছে। কিন্তু পাহাড় সেনানিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেখানে প্রবেশ করা কঠিন। তাছাড়া রাজনৈতিক চাপও থাকে। কোনো বাহিনীকে না ধরার অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা অনেক সময় মেনে চলতে হয়।

তিনি বলেন, একজন নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে ধরতে আমাদের কোনো অনুমতি লাগে না। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর নেতাকে ধরতে গিয়ে প্রশাসনিক স্তরে বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, নেপালে তো পাহাড় আর পাহাড়, তাই বলে কী সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলে। এগুলো সদিচ্ছার অভাব। প্রশাসন চাইলে একদিনেই নিয়ন্ত্রণ করেতে পারে।

বালুমহাল আর অবৈধ ইটভাটার নিয়ন্ত্রণ নিতেই এ হত্যাযজ্ঞ

রাউজানের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। এই নদী শুধু পানি পরিবহনের মাধ্যমই নয়, এটি হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাণিজ্য ও প্রভাব বিস্তারের প্রাণকেন্দ্রও। এ নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বালুমহাল, ইটভাটা, ইট-বালু-মাটি সরবরাহ, কাঠ চোরাচালান ও মদ পাচার; এমনকি বিল ভরাটের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের মতো বহু কোটি টাকার ব্যবসা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বেশি, যার হাতে বাহিনী বেশি, তিনিই এসব ব্যবসার ‘নিয়ম নির্ধারক’। একসময় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করত আজিজ বাহিনী, পরে তা হাতে নেয় রায়হান, মোহাম্মদ ফরিদ, মো. আলমগীর প্রকাশ টেম্পু, মো. খোকন, বাদশা মিয়া, মান্নানসহ দুই নেতার একডজন সন্ত্রাসী। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা চাঁদা ওঠে অবৈধ বালুমহাল ও ইটভাটা থেকে। এখন বিএনপির দুই পক্ষ গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকার তাদের অনুসারীদের দিয়েই এ ব্যবসাগুলো ভাগ করে নিতে চাইছেন।

স্থানীয় একজন সাংবাদিক বলেন, রাউজান এখন আর শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র নয়, এটা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে যার হাতে অস্ত্র, তার দখলে বালুমহাল, ইটভাটা, এমনকি নদীর ঘাটও। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দুর্বল বলেই এ জনপদ আজ সন্ত্রাসীদের দখলে।

পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি। রাউজানের আশপাশে সবগুলো পাহাড়, সন্ত্রাসীরা গুলি করে পাহাড়ে হারিয়ে যায়। সেজন্য তাদের ধরতে আমাদের বেগ পেতে হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত