যশোরে পুলিশের নির্মমতা

গুলিতে চিরদিনের জন্য পঙ্গু দুই শিবির নেতা

আহসান কবীর, যশোর
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ২৩

আওয়ামী দুঃশাসনের নির্মম দিন ছিল ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট। সন্ধ্যার দিকে যশোরের চৌগাছা থানার এসআই মোখলেস, এএসআই মাজেদসহ কয়েক পুলিশ সদস্য মিলে উপজেলার বুন্দলিতলায় একটি মোটরসাইকেল থামায়। তারা পাকড়াও করেন দুই তরুণ রুহুল আমিন এবং ইসরাফিল হোসেনকে। পুলিশ সদস্যরা তল্লাশি করে ওই দুজনের কাছ থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের অর্থ সংগ্রহের রসিদ ও মাসিক সাংগঠনিক রিপোর্ট পান। এ অভিযোগে তাদের আটক করা হয় এবং একদিন পর একই স্থানে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে তাদের পায়ে গুলি করা হয়। পরে তাদের একটি করে পা কেটে ফেলতে হয়।

ফ্যাসিবাদী সরকার বিতাড়নের পর এ ঘটনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) শরণাপন্ন হন ইসরাফিল এবং রুহুল। ঠান্ডামাথায় গুলি করে দুই তরুণের পা নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে যশোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) আনিসুর রহমান, চৌগাছা থানার তৎকালীন এসআই আকিকুল ইসলামসহ ছয়-সাতজনকে। এ মামলায় পুলিশ কনস্টেবল সাজ্জাদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে গত ১০ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেয়।

বিজ্ঞাপন

ইসরাফিল এবং রুহুল বলেন, সাংগঠনিক কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাদের ধরে প্রথমে চৌগাছা থানায় নেয়। সেখানে এক রাত তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চলে। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে পাঠানো নাস্তা খান তারা। দুপুরে তাদের আদালতে হাজির করার নামে যশোর ডিবি অফিসে নেন থানার তখনকার এসআই আকিকুল ইসলাম। সেখান থেকে সন্ধ্যায় ফের চৌগাছার উদ্দেশে তাদের নিয়ে রওনা হয় পুলিশের গাড়ি।

তারা আরো বলেন, যশোর-চৌগাছা সড়কের কয়ারপাড়া এলাকায় দুজনের চোখ বেঁধে হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাপ পরানো হয়। এর কিছু সময় পর যেখান থেকে তাদের আটক করা হয়েছিল, সেই বুন্দলিতলার নির্জন মাঠে নিয়ে তাদের একটি করে পায়ে গুলি করে পুলিশ। এরপর চোখ থেকে কাপড় খুলে তা পায়ের হাঁটুতে বেঁধে দেওয়া হয়। গুলি করার পর পুলিশ সদস্যরা চিৎকার করে গালাগালি করতে থাকেন। এতে আশপাশের কিছু লোক সেখানে এলে এসআই আকিকুল আহত দুজনকে না চেনার ভান করে তাদের নাম জিজ্ঞাসা করতে থাকেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, এরপর তাদের প্রথমে নেওয়া হয় চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে। তৃতীয় দিন তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল)। সেখানে সাতদিনের মাথায় তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পা দুটি কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা। এরপর দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে করা অস্ত্র মামলায় আদালতের মাধ্যমে তাদের যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর দুজনকে জামিনে মুক্তি দেয় আদালত।

ইসরাফিল এবং রুহুলকে আটকের পরদিন আমার দেশ-এর চৌগাছা প্রতিনিধি রহিদুল ইসলাম খান পেশাগত কাজে থানায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রুহুল এবং ইসরাফিলকে হাজতখানায় আটক থাকতে দেখেন। ওই দুই তরুণের সঙ্গে কথাও হয়েছিল জানিয়ে রহিদুল বলেন, ‘ক্রসফায়ারের ওই কাহিনি ছিল সে সময়ের অন্য ঘটনাগুলোর মতো সাজানো। ওরা শিবির করত। তাই পরিকল্পিতভাবে গুলি করে পা নষ্ট করে দেয় পুলিশ। এখন যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘটনাটির বিচার হচ্ছে, আমার এ বক্তব্য প্রমাণ হবে।’

রুহুলের প্রসঙ্গ তুলতেই তার মা রোজিনা খাতুন ডুকরে কেঁদে ওঠেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আমি সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছি। অনেক কষ্টে পড়ালেখা করিয়েছি। পুলিশ গুলি করে ছেলেটাকে খোঁড়া বানিয়ে দিয়েছে।’ আর বেশি কথা বলতে পারলেন না মধ্যবয়সি এই কৃষকবধূ।

ফোন পেয়ে রুহুল আমিন কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে এসেছিলেন আমার দেশ-এর যশোর অফিসে। প্রায় ৯ বছর আগে কেটে ফেলা পায়ের চিকিৎসা চলছে এখনো। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না।

ক্রসফায়ার নাটকের শিকার ইসরাফিল এবং রুহুল পরস্পর বন্ধু। সে সময় ইসরাফিল যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে অর্থনীতি এবং রুহুল একই প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষে পড়তেন। তারা ছাত্রশিবির চৌগাছা উপজেলা শাখার যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক এবং সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন।

ইসরাফিল বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনে ন্যায়বিচার পাবেন না ধরে নিয়ে তারা আইনের আশ্রয় নেননি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিচার পাওয়ার আশায় ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়েছেন।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত রুহুল আমার দেশকে বলেন, ‘আমাদের দুই বন্ধুর জীবন শেষ করে দিয়েছে যশোরের তৎকালীন কুখ্যাত এসপি আনিস এবং তার বাহিনীর খুনি সদস্যরা। আমরা দুজনই গরিব ঘরের সন্তান। আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়ায় আনিস ও তার সহযোগীদের বিচার চাই।’

এ ঘটনায় অভিযুক্ত চৌগাছা থানার তৎকালীন এসআই আকিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করে বলেন, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না তা আমার মনে নেই।’

পা হারানো ইসরাফিল চৌগাছা উপজেলার চুটারহুদা গ্রামের গরিব কৃষক আবদুর রহমানের ছেলে। তার এক ভাই কৃষক, এক ভাই রাজমিস্ত্রি এবং আরেক ভাই বাসের সুপারভাইজার। সবচেয়ে ছোট ইসরাফিল যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

রুহুল একই উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের ইমদাদুল হকের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় রুহুল। ছোট ভাই ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর রুহুল অনার্স শেষ করতে পারেননি। কৃষক পরিবারের এই সন্তান পরে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

ইসরাফিলের ভাই বাসের সুপারভাইজার শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের যে দিন গেছে তা মুখে বর্ণনা করা যাবে না। ভাইকে গুলি করে পা খোঁড়া করে দিয়েও পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি। প্রায়ই বাড়িতে এসে হাঙ্গামা করত। টাকা দাবি করত। আমরা গরিব মানুষ, টাকার অভাবে ভাইয়ের চিকিৎসা খরচও ঠিকমতো চালাতে পারিনি।’

ইসরাফিল ও রুহুল দুজনেরই একটি করে কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। দুজন তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরে জানান, পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেননি। এখনো চিকিৎসা শেষ হয়নি তাদের। তবু জীবনের তাগিদে চাকরি করতে হচ্ছে। পা হারানোর পর আগের সেই আনন্দময় জীবন নেই তাদের। এখন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন না। তবে রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের কারণে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন।

বন্দুকযুদ্ধের নামে ঠান্ডামাথায় গুলি করে দুই তরুণের পা নষ্ট করে দেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত যশোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান নৌ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) থাকাবস্থায় লাপাত্তা হন। সরকার পতনের পর গোপালগঞ্জের এই বিতর্কিত অফিসারকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে সংযুক্ত করা হলেও তিনি সে আদেশ মানেননি। পুলিশের কোনো কর্মকর্তাও তার হদিস জানেন না।

আনিসুর রহমান যশোরের এসপি থাকাকালে বহু ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘জঙ্গি নাটক’ হয়েছে। পুলিশ বিভাগে বলাবলি আছে, তার আগে-পরে যশোরে এত নৃশংস, দুর্নীতিবাজ, বেপরোয়া পুলিশ কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। হাসিনা সরকারের পতনের পর এসপি আনিসের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে অজ্ঞাত স্থান থেকে যোগাযোগ করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছেন আনিস।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত