সীমানা জটিলতায় ভোগান্তিতে পদ্মাপাড়ের মানুষ

জহুরুল ইসলাম, পাবনা
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১০: ২২

পদ্মা পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় পাবনা ও কুষ্টিয়ার ১৬ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। কাগজে-কলমে এক জেলার বাসিন্দা হলেও জীবন-জীবিকার প্রায় সব চাহিদাই মেটাতে হয় অন্য জেলায় গিয়ে। নদী-বালুর সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া এই মানুষদের দুঃখ-দুর্দশার যেন শেষ নেই।

সীমানার অদ্ভুত জটিলতায় পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ও দোগাছি ইউনিয়নের সাত গ্রাম চলে গেছে পদ্মার ওপারে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পাশে। আবার কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের ৯ গ্রাম রয়ে গেছে পদ্মার এ পাড়ে, পাবনার গা ঘেঁষে। ফলে প্রশাসনিকভাবে এক জেলায়, অথচ জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণ অন্য জেলায়—এমন অস্বস্তিকর বাস্তবতায় যুগ যুগ ধরে জীবন কাটছে হাজারো মানুষের।

বিজ্ঞাপন

শিলাইদহ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, আধঘণ্টা পরপরই নৌকায় করে নদী পার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে কৃষক সবারই একই গন্তব্য—নিজ জেলার অফিস, কাছারি বা বাজার।

কেউ চিকিৎসার জন্য আসছেন, কেউ আসছেন জমিজমার কাগজপত্রে সই করতে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার ধু-ধু বালুচরে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটা তাদের নিত্যদিনের যন্ত্রণা।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কলেজছাত্র আবু সালেহীন বলেন, পাসপোর্টের কাজ করতে পাবনা শহরে যেতে হয়। বর্ষায় নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড়ি দিতে হয়। বছরের পর বছর ধরে আমরা একই দুর্ভোগে আছি।

পাবনার ভাঁড়ারা ইউনিয়নের সচিব সেলিম উদ্দিন জানান, নদীর ওপারে থাকা ৭ গ্রামের মানুষ ইউপি কার্যালয় বা কোর্ট-কাছারির কাজে এ পাড়ে আসেন। এতে সময়, অর্থ ও ঝুঁকি সবই বেড়ে যায়।

কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। ২৫ বর্গমাইলের এ ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস করলেও নেই সঠিক সড়ক, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কে বড় বড় গর্ত, ইট-খোয়া বিলীন হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলায় হাঁটু সমান ধোঁয়া ওড়ে, বর্ষায় রাস্তাঘাট কাদার সাগরে পরিণত হয়।

প্রশাসনিক নজরদারি না থাকায় এলাকায় বেড়ে চলেছে মাদক, বাল্যবিয়ে, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি কোনো সেবা পৌঁছায় না এই দুর্গম চরে। সার, বীজ কিংবা ত্রাণ—সব থেকেই তারা বঞ্চিত।

স্থানীয় বাসিন্দা ইজিবর হোসেন বলেন, চরসাদিপুরের মানুষ সব কাজে পাবনার ওপর নির্ভরশীল। ইউনিয়নটি যদি পাবনা জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে অবহেলিত মানুষগুলো উন্নয়নের আলো দেখবে।

৭০ বছরের প্রবীণ শাহেদা আক্তার বলেন, আমি কুষ্টিয়ার বাসিন্দা; কিন্তু জীবনে কোনোদিন কুষ্টিয়া শহরে যাইনি। সবকিছুই আমাদের পাবনা শহরকেন্দ্রিক।

এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করে পাবনার স্কুল-কলেজে। তবে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হয় কুষ্টিয়ায়। ফলে নদী পাড়ি দিতে না পারায় অনেকেই সঠিক সময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না।

চরসাদিপুরের তরুণদের অনেকেই এখন পাবনার ভোটার হয়েছেন। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রিমন হোসেন জানান, আমরা চরসাদিপুরের মানুষ; কিন্তু ভোটার হয়েছি পাবনার। এখানকার নতুন প্রজন্মও ভোটার হচ্ছে পাবনায়।

স্থানীয়রা মনে করেন, পদ্মা নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাস্তবতার ভিত্তিতে নিকটবর্তী জেলার সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে যুক্ত করাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। অন্যথায় কাগজে-কলমে এক জেলার, জীবন-জীবিকায় অন্য জেলার—এই অবহেলার চক্র থেকে মুক্তি মিলবে না।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত