সারা দেশের মতো নাটোরেও বইছে ভোটের হাওয়া। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জমে উঠেছে প্রচার কার্যক্রম। উৎসবমুখর এ পরিবেশ কিছুটা ম্লান করেছে দুই আসনে বিএনপির প্রার্থী জটিলতা।
ধানের শীষের নমিনি ঘোষণার পরও সক্রিয় আছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতা। এমনকি কারো কারো মুখ থেকে আসছে বিদ্রোহ করারও ঘোষণা। তিনবার সরকারে থাকা দলটি যখন এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তখন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী ব্যস্ত আছে বিরামহীন ঐক্যবদ্ধ প্রচারে। নানা কর্মসূচিতে রাত-দিন এক করে ফেলছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোরের চারটি আসন। এখানে দুই দফায় ধানের শীষের কান্ডারির নাম ঘোষণা করে বিএনপি। তারা নানা কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছেন, দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি। আর জামায়াত প্রায় বছরখানেক আগে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করায় ইতোমধ্যে তারা ভোটের মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। দাঁড়িপাল্লার নমিনি হিসেবে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। এছাড়া ইসলামি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ অন্য দলগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে।
নাটোর-১ (লালপুর ও বাগাতিপাড়া)
বিএনপি এ আসনে অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুলকে মনোনয়ন দিলেও তার আপন ভাই ডা. ইয়াসির আরাফাত রাজন ও দলটির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু আশা ছাড়েননি। তাদের অনুসারীরা পুতুলের মনোনয়ন বাতিল ও নিজ নিজ নেতাকে দলীয় টিকিট দেওয়ার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও ভোট করবেন বলে বেশ কয়েকটি সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছেন টিপু।
ধানের শীষ পেতে চেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে টিপু বলেন, ‘ভোটের মাঠে কাজ করতে দলের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। দল চাইলে শেষ মুহূর্তেও মনোনয়ন পরিবর্তন করতে পারে, তাই লেগে আছি। তবে শেষ পর্যন্ত দল মনোনয়ন না দিলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
জামায়াত এখানে লালপুর উপজেলা শাখার আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে প্রার্থী করেছে। তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনি এলাকার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন। দলীয় কোনো কোন্দল না থাকায় প্রচারে পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা।
নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা)
এখানে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী হওয়ার জন্য কারো দৌড়ঝাঁপ নেই, কারণ দুই দলেই আছে একক প্রার্থী। বিএনপিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক উপমন্ত্রী এ আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর কথাই এখানে দীর্ঘদিন ধরে শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দল থেকেও তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার প্রার্থিতার বিরুদ্ধে অন্য কোনো নেতার তৎপরতাও নেই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন সবাই।
অপরদিকে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির বাগতিপাড়া সরকারি ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইউনুস আলীকে দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী করা হয়েছে। তিনিও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় সভা, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর কাছে খুব সামান্য ভোটে পরাজিত হয়ে সাড়া ফেলেছিলেন অধ্যাপক ইউনুস। তাই দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এবারও ভোটের মাঠে তিনি চমক দেখাবেন।
নাটোর-৩ (সিংড়া)
প্রার্থী জটিলতার কারণে প্রথম দফায় এখানে ধানের শীষের কান্ডারির নাম ঘোষণা করতে পারেনি বিএনপি। পরে দ্বিতীয় দফায় অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনুকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি উপজেলা বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
আসনটিতে বরাবরই বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে। তবে ১৯৯১ সালে এখানে জামায়াতের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন আবু বকর শেরকোলী। এরপর থেকে আসনটি বিএনপির হাতেই ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয় উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক দাউদার মাহমুদকে। এখানে বেশ কয়েক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তারা এখন কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কেউ ধানের শীষে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামেননি। ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় প্রচারে পিছিয়ে পড়ছেন প্রার্থী।
এখানে মনোনয়নবঞ্চিত জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দাউদার মাহমুদের কর্মী-সমর্থকরা অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনুর মনোনয়ন বাতিল করে পুনরায় বিবেচনা করার জন্য কেন্দ্রের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, যিনি দীর্ঘ ১৭ বছর সব আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকে নির্যাতিত হয়েছেন, আজ তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমরা তারেক রহমানকে বলতে চাই, দুঃসময়ে দলের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের একটাই দাবিÑএই মনোনয়ন বাতিল করতে হবে। নাটোর-৩ আসনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করতে হলে দাউদার মাহমুদকে প্রয়োজন।
জামায়াত নাটোর জেলা জামায়াতে শূরা ও কর্মপরিষদের সদস্য অধ্যাপক সাইদুর রহমানকে প্রার্থী করেছে। তিনি ঐক্যবদ্ধ নেতাকর্মী নিয়ে গণসংযোগ করে রাত-দিন এক করে ফেলছেন। এছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এনসিপির জেলা সদস্য সচিব রাজশাহী নিউ অধ্যক্ষ এস এম জার্জিস কাদির এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা খলিলুর রহমান।
নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম)
আসনটিতে বিএনপি ও জামায়াত একেবারে সমান তালে নির্বাচনি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এখানে ধানের শীষের নমিনি করা হয়েছে গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আজিজকে। তিনি দুই উপজেলা জুড়ে সভা-সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে নিয়মিত অংশ নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে এখানে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা শাখার সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক মাওলানা আবদুল হাকিমকে। তিনি বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। বেশ কিছুদিন তিনি উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। দুই উপজেলা জুড়ে তিনিও দীর্ঘদিন থেকে সক্রিয়ভাবে প্রচার চালাচ্ছেন।
তরুণ ভোটার মামুন বলেন, এখন একটা রিকশা চালকও অনেক সচেতন। তারা নিজের ভালো-মন্দ জানে এবং বুঝে। খিচুড়ি খাওয়ার জন্য অনেকেই নেতাদের সভায় যায়। প্রকৃতপক্ষে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা তাল মিলিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে বৃহৎ দল বিএনপির কর্মী-সমর্থক বেশি হলেও অন্তর্কোন্দল ও প্রার্থী জটিলতার কারণে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া কষ্টসাধ্য হবে।
নাটোর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক ড. মীর মো. নূরুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি, দখল, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কারণে রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলেও জামায়াত নেতাকর্মীরা এসবের ঊর্ধ্বে আছেন। আমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায় ভোটের মাঠে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। জনগণের ভোটে ক্ষমতা পেলে বৈষম্যহীন একটা রাষ্ট্র উপহার দেবে জামায়াত।
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রহিম নেওয়াজ বলেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে যিনি মনোনয়ন পাবেন তার জন্যই সব নেতাকর্মী ভোটের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিএনপি দীর্ঘ আন্দোলন করেছে। আন্দোলনের সুফল হিসেবেই এখন দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরেছে। যার প্রতিদান হিসেবেই মানুষ এবার বিএনপিকে ভোট দেবে।

