আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

অবৈধভাবে পুলিশ ক্যাডারে আ.লীগ নেতার বোন রাজিয়া

বাদশাহ ওসমানী, রংপুর

অবৈধভাবে পুলিশ ক্যাডারে আ.লীগ নেতার বোন রাজিয়া
রাজিয়া সুলতানা

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা করেছে ২৯, ৩০ এবং ৩১তম বিসিএসের নিয়োগের ক্ষেত্রে। এ তিন বিসিএসে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনেককে। যার মধ্যে একজন সুলতানা রাজিয়া। তিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে ৩০তম বিসিএসে নিয়োগ পান। আওয়ামী লীগ নেতার বোন হওয়ায় তাকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে, যা এখন তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

পুলিশ ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার ২৯তম বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধপন্থা অবলম্বন করে ২১ ভুয়া ক্যাডার নিয়োগ দেয়। একই পন্থায় ৩০ এবং ৩১তম বিসিএসে ৪১ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পিএসসিতে নন-ক্যাডারে নাম থাকার পরও পরবর্তী সময়ে আলাদা গেজেট প্রকাশ করে বেআইনিভাবে ক্যাডার পদে ১৮ জন নারীকে ৩০তম বিসিএসের অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলামের বোন এবং আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার সোহেল সিরাজের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়াও রয়েছেন। পুলিশ ক্যাডারে যাকে সে সময় সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, পুলিশে যোগদানের পরই সুলতানা রাজিয়া আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে জোর দেন। তিনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিরোধী মতের লোকজনকে দমনে উঠেপড়ে লাগেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসির তৎকালীন এক সদস্য আমার দেশকে জানান, মেধাভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া এড়িয়ে সে সময় সুলতানা রাজিয়াকে নিয়োগ দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার স্বাক্ষরিত আলাদা গেজেট জারি করে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে সুলতানা রাজিয়া একজন। তবে ওই সময়ের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা ও পিএসসির কিছু সদস্য এ অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন এবং একটি সিন্ডিকেট দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক টাকা কামিয়ে নেয়।

২০১২ সালের ১৭ মে ৩০তম বিসিএসের মূল গেজেট প্রকাশিত হয়। সে গেজেটে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশকৃত দুই হাজার ২৬২ জনের নাম ছিল। এর পাঁচ মাস পর একই বছরের ২৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৮ জন নারীকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য একটি পৃথক গেজেট জারি করে। যদিও তাদের নাম ইতঃপূর্বে নন-ক্যাডার তালিকায় ছিল। পিএসসির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই ১৮ নারীর মধ্যে সুলতানা রাজিয়াও ছিলেন।

আখতার জাহান রুজি একজন শিক্ষক। তার সন্তান একজন বিসিএস ক্যাডার। তিনি আমার দেশকে জানান, আওয়ামী লীগের সময় অবৈধভাবে তাদের লোকজনকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছে। কিন্তু তারা বিএনপি জামায়াত বা ইসলামপন্থীদের কোনো ছেলে-মেয়েকে বিসিএসে পাস করার পরও ক্যাডার হিসেবে নেয়নি। এমনকি গেজেটে নাম আসার পরও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় রাজিয়া ঠাকুরগাঁয়ের সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের লোকজন এবং দলের নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করেন। এ সময় তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আওয়ামী লীগের স্বার্থ হাসিল করেন তিনি। একইভাবে তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনে রংপুরের এডিশনাল এসপি থাকাকালীন ভোট কারচুপিতে সহযোগিতা করেন। যার মাধ্যমে রংপুরে ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়। তার আগে তিনি রংপুরের সাবেক পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারের পরামর্শে জেলার বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামপন্থিদের গ্রেপ্তার করতেন। এরপর তাদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হতো বিভিন্ন মামলায়।

এ বিষয়ে বিএনপির রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু জানান, সাবেক এসপি বিপ্লব কুমার সরকারের সহযোগী অ্যাডিশনাল এসপি রাজিয়া বিএনপির অনেক ক্ষতি করেছেন। তাকে যে অবৈধভাবে পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার কর্মকাণ্ডে তিনি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমরা চাই অপরাধী সব পুলিশকে বিচারের আওতায় আনা হোক।

রংপুর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা এনামুল হক জানান, আওয়ামী লীগের সময় জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে বিনা দোষে হত্যার পাশাপাশি জঙ্গি নাটক সাজিয়েও নির্যাতন করা হয়। এ সময় আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় ডজন ডজন মিথ্যা মামলা। এক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামীমনা অতি উৎসাহী পুলিশের লোকজন। রংপুরের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজিয়াও ক্ষতি করেন। আমরা তদন্তসাপেক্ষে দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঠিক বিচার আশা করছি।

পুলিশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, সুলতানা রাজিয়া পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর শিক্ষানবিশ সময় শেষ করে রংপুরে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পরিবার আওয়ামীপন্থি, ভাই আওয়ামী লীগের নেতা এবং স্বামী ব্যাংকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়ায় রাজিয়া বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পান। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে পুলিশে বিদ্রোহ সৃষ্টির যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের ইন্ধনদাতার মধ্যে রাজিয়া ছিলেন অন্যতম। সেই রাজিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে দিনাজপুরের শহর সার্কেলে অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

তারা আরো বলেন, রাজিয়ার স্বামী সোহেল জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নানা উসকানিমূলক পোস্ট দেন ফেসবুকে। এক পোস্টে তিনি লিখেন—‘ঘরে ঘরে খবর দে, এক দফার কবর দে’। রাজিয়ার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম কুড়িগ্রামে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। পুলিশের কাছে এত কিছু তথ্য থাকার পরও কীভাবে তাকে আবারও একটি জেলায় বদলি করা হয়েছে তা ভবনার বিষয়। মাস দুয়েক পরই নির্বাচন। তিনি এখন পুনরায় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পেলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা দাবি করেন, রাজিয়ার মতো অবৈধ পন্থায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে তারা আবারো পুলিশের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে দেশের অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, আমি বৈধ পন্থায় পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছি। আমার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা হতেই পারে, স্বামী আওয়ামী লীগ করতেই পারে, আমি তো আওয়ামী লীগ করি না। আমি যেখানে চাকরি করেছি সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছি আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও কেউ দিতে পারবে না।

বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনকে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিইনি, কাউকে হয়রানিও করিনি। আমাদের যতটুকু কাজ করতে হয়, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই করতে হয়। নির্বাচনগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তারা যেভাবে দায়িত্ব পালন করেন আমি সেভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমি কোনো অন্যায় করিনি।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন