ভারতের পানিযুদ্ধের অবসান চায় তিস্তাপাড়ের মানুষ

হাসান উল আজিজ, লালমনিরহাট
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৫৫

স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত নদীটির পানি তাদের খেয়ালখুশিমতো নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে ভারত সব গেট বন্ধ রেখে পানি আটকায়, বাংলাদেশে দেখা দেয় ভয়াবহ পানিসংকট। আবার বর্ষাকালে হঠাৎ সব গেট খুলে দিয়ে তিস্তার অববাহিকায় বন্যার সৃষ্টি করে প্রতি বছর। এতে জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়ে নদী তীরবর্তী লাখ লাখ মানুষের। ভারতের ইচ্ছাকৃত এ আচরণ শুধু অন্যায় বা অন্যায্যই নয়, আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিরও চরম লঙ্ঘন।

পানি নিয়ে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতায় তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ অংশে শুষ্ক মৌসুমে জেগে উঠছে বড় বড় চর। জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে মারাত্মক প্রভাব। সেই সঙ্গে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশ ও এর জনগণ। আবার বর্ষাকালে সেই গজলডোবার ৫৪টি গেটের সব খুলে দেওয়ায় তিস্তা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা ও ভাঙন হয়ে পড়েছে নৈমিত্তিক বিষয়। এতেও প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষকে মানবিক ও আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

তিস্তাপাড়ের দুই কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর এ ভয়াবহ হুমকি থেকে রক্ষা

করতে দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদী তিস্তা। ভারতের সিকিমের কানসি হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে কোচবিহারের মেখলীগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটির ভারতে থাকা অংশ বেশ খাড়া হওয়ায় সেটিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ পেতে সিকিমে চারটি বাঁধ তৈরি হয়। বন ও পরিবেশ দপ্তরের পরিবেশ সুরক্ষার গাইডলাইন না মেনেই ১৯৭৬ সাল থেকে তৈরি হয় এসব বাঁধ। পাশাপাশি প্রায় ৫৮ কিলোমিটার সংযোগকারী খাল তৈরি হয়।

একই সঙ্গে দুটি প্রকল্পের অধীন একাধিক বাঁধ নির্মাণে নদী চলার স্বাভাবিক ছন্দ পুরোপুরি বিঘ্নিত হয়েছে। এর ওপর চেপেছে গজলডোবা বাঁধ। ফলে পুরো তিস্তা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করছে ভারত। এতে পাল্টে গেছে তিস্তার পানি ও পলি প্রবাহের স্বাভাবিক চরিত্র। দিনদিন কমে আসছে তিস্তার পানিপ্রবাহ।

এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগীরা। ২০১১ সালে বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বারবার আপত্তির কারণে তা কার্যকর হয়নি। এরপর বাংলাদেশ সরকার বিকল্প চিন্তা হিসেবে শুরু করে।

যার ফলশ্রুতিতে তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে তিস্তা মহাপরিকল্পনা এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। একই বছর মার্চে বাংলাদেশকে চীনা প্রতিষ্ঠান এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্রুত তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহ দেখায় তারা। বিনিয়োগেও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি।

এতে নড়েচড়ে বসে ভারত সরকার। ভারত আশঙ্কা করছে, তিস্তা অববাহিকা দিয়ে প্রবাহিত শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা—সেখানে চীনা উপস্থিতি তাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ কারণে তারা প্রকল্পটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে বিষয়টি ঝুলে পড়ে।

‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ সংগ্রাম পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, তিস্তা মেগা প্রকল্প এবং চুক্তি বাস্তবায়ন এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এ দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারি রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা সমবেত হয়ে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তাদের ন্যায্য দাবির কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীপাড়ের দুই কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ভয়াবহ হুমকি থেকে রক্ষা করতে দ্রুত তিস্তাচুক্তি সই করতে হবে। আর দিল্লির তাঁবেদারি নয়, তিস্তার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে না পারলে আগামী দিনে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। আমরা দ্রুত সময়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই।

তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগী মানুষজন বলছেন, যখন পানি চাই, তখন পাই না। আর যখন পানির কোনো প্রয়োজন নেই, তখন পানির আধিক্যে আমরা বন্যায় ডুবি। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন এলাকার ব্যবসায়ী দবিয়ার রহমান ভারতের অমানবিক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বারবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি সুরাহা করা হয়নি। এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, তিস্তায় প্রয়োজনমতো পানি এলে দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ অংশের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো। একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হতো, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার আশপাশের নদীগুলোতে সার্বক্ষণিক পানি পেলে কৃষকরা খুব সহজেই ও কম খরচে সেচ সুবিধা পেতো। বেড়ে যেত খাদ্য উৎপাদন।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বন্যা, নদীভাঙন সমস্যা সমাধানসহ এ অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, এটি হয়ে উঠবে উত্তরাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদ।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত