ছয় জুলাইযোদ্ধাকে পুড়িয়ে হত্যা করেন আ.লীগ নেতা

হাসান উল আজিজ, লালমনিরহাট
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ০৮

হয়রানিমূলক মামলা, হামলা, নির্যাতন, হত্যা, জঙ্গিনাটক, জমি দখলসহ নানা অপকর্মই ছিল লালমনিরহাটে আওয়ামী আমলের নমুনা। ফ্যাসিবাদী শাসনামলে দলীয় সন্ত্রাস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলবাজ কর্মকর্তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল জনজীবন। ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য গুম-খুনকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জেলাজুড়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হতাহত এবং সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনামলে গুম-খুনের শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাকে লেডি হিটলার আখ্যায়িত করে তারা বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা নিয়েই দেশ ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ওই অত্যাচারী শাসকের চেয়ে কোনো অংশে কম জুলুম করেননি। একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করে ক্রমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ১১ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কাল্পনিক মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর দলটির ডাকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচিতে জেলার পাটগ্রামে ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপজেলা শাখার সভাপতি মনিরুল ইসলাম, জামায়াতকর্মী আবদুর রহিম ও শিবিরকর্মী সাজু মিয়াকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। সে সময় পাটগ্রামের ওসি ছিলেন সোহরাব হোসেন।

এই ‍দুঃশাসনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় জুলাই বিপ্লবের সময়। গত বছরের ৫ আগস্ট আন্দোলনের দিন লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা সুমন খানের বাড়িতে ৬ ছাত্রকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অপরদিকে জুলাই আন্দোলনে এ জেলার তিন তরুণ ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এ নিয়ে হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ভয়াবহ দুঃশাসনে লালমনিরহাটে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী মত দমনে ছয় শতাধিক গায়েবি মামলা দায়ের করে ৫০ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে ঘরছাড়া করা হয়।

আওয়ামী মাফিয়া তন্ত্র

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের দুঃশাসনে মাফিয়ায় পরিণত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের দমনপীড়নে ভিন্নমতের মানুষের রাজনীতি করাই ভীতিকর ছিল। দেড় দশকে যারা অত্যাচার নির্যাতনের শিরোমণি ছিলেন, তাদের মধ্যে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামানের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহম্মেদ এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের ছেলে মাহমুদুল হাসান সোহাগ উল্লেখযোগ্য।

দুর্নীতি, দখল ও সংখ্যালঘু নির্যাতন

হাসিনার আমলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে লালমনিরহাটের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকে কাজে লাগিয়ে লালমনিরহাট-২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) আসনের সাবেক এমপি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ ও তার ছেলে রাকিবুজ্জামান আহম্মেদ নিয়োগবাণিজ্য, সরকারি দপ্তর নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার কমিশন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, জমি দখল, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।

মন্ত্রী নুরুজ্জামানের সব অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালাতে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন তার ছেলে রাকিবুজ্জামান। এ বাহিনীর অন্যতম কাজ ছিল দখল ও চাঁদাবাজি। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারত না। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি নুরুজ্জামান রংপুর শহরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হলেও এখনো লাপাত্তা তার ছেলে রাকিবুজ্জামান। ইতোমধ্যে নুরুজ্জামানের নামে দুর্নীতির তিনটি মামলা হয়েছে। তার স্ত্রী ও ছেলের বিরুদ্ধে সাড়ে ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৩৪ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অপরদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় তার ছেলে হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান সোহাগের ছিল একাধিক ক্যাডার বাহিনী। এই ক্যাডার বাহিনী হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাবার মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে কোটি টাকার রাজকীয় গাড়িতে চলাফেরা করতেন সোহাগ। সব সময় ঘুরতেন ক্যাডার বাহিনী নিয়ে।

জামায়াত-শিবির নির্মূলে সর্বশক্তি প্রয়োগ

লালমনিরহাটে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। তাদের বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার আর ভুয়া মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। মিছিল-মিটিং করলেই ধাওয়া বা ঘেরাও করে যেমন গ্রেপ্তার করা হতো, তেমনি দিনে-রাতে বাসাবাড়ি, অফিস বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে কাউকে পাওয়া গেলেই ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিচিত নেতাকর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারতেন না। পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন। তাদের অধিকাংশ মামলা এখনো চলমান।

তুলে নিয়ে জঙ্গিনাটক

আওয়ামী লীগ কথিত জঙ্গিবিরোধী কর্মসূচিকে বিরোধী মত দমনের প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছিল। জঙ্গিনাটক সাজিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জামায়াত-শিবির নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে রাখত। এভাবে জেলখানায় বছরের পর বছর বিনা অপরাধে কারাভোগ করতে হতো।

হাতীবান্ধার পূর্ব সিন্দুর্ণা গ্রামের ছাত্রশিবিরকর্মী নাহিদ হাসান বলেন, ‘আমি ফেসবুকে বা অনলাইনে লেখালেখি করতাম। লেখাগুলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমার ওপর তাদের কুনজর পড়ে। তারা আমাকে হুমকি মনে করায় তুলে নিয়ে জঙ্গি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। এ নিয়ে ৪৩ বছরের সাজা হয়। চলতি বছরের জুনে আদালত আমাকে অস্থায়ীভাবে ছয় মাসের জন্য জামিন দেয়। এখনো মামলা চলমান আছে। আমার মতো এ ধরনের আরো অনেককে নিয়ে জঙ্গিনাটক সাজিয়েছে আওয়ামী সরকারের দলবাজ বাহিনী।’

সাংবাদিক নির্যাতন

লালমনিরহাটে বাক্‌, চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে হাসিনার সময়ে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীর হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। সত্য কথা বলার অপরাধে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হয়। এছাড়া সাংবাদিকদের ওপর সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি থাকত।

ছয় শিক্ষার্থীকে পুড়িয়ে হত্যা

গত বছরের ৫ আগস্ট আন্দোলনের দিন শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল শহরের মিশনমোড় থেকে শহীদ মিনারের দিকে অগ্রসর হলে সেখানে হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। পরে ছয় ছাত্র প্রতিনিধি জোবায়ের হোসেন, আল শাহরিয়ার রিয়াদ তন্ময়, শাহরিয়ার আল আফরোজ শ্রাবণ, জনি মিয়া, রাধিক হোসেন রুশো ও রাজিব উল করিম সরকারকে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বাড়িতে নিয়ে একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ঘটনার ১০ মাস পর গত ২৭ মে জুলাইযোদ্ধা আরমান আরিফ একটি মামলা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা সুমন খান ওরফে হুন্ডি সুমনকে এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আরিফ বলেন, মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আমাদের সহযোদ্ধা ছয়জনকে আটক করে বাড়িতে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেন। ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপ না দেখে আশাহত হয়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর অংশ হিসেবে মামলাটি করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না।

শহীদ রিয়াদের মা নাসরিন পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে।

এছাড়া জোবায়েরের বাবা জহিরুল ইসলাম, শ্রাবণের বাবা সাইদুর রহমান, রাজিবের বাবা রেজাউল করিম সরকার, জাহিদুরের বোন খুশি বেগম এবং রাদিফের বাবা জিয়াউর রহমান এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবির জানিয়েছেন।

লালমনিরহাট সদর থানার ওসি মোহাম্মদ নুরনবী বলেন, মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা সুমন খানসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, ১১ আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সুমন খান ছিলেন লালমনিরহাটের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন। তার ছিল বিশাল ক্যাডার বাহিনী। সেই বাহিনী দিয়ে তিনি সব অপকর্ম করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৫ আগস্ট সুমনের বাড়ি থেকে ৬ শিক্ষার্থীর দগ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।

আওয়ামী গডফাদার হুন্ডি সুমন

চোরাচালান, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক, স্বর্ণ পাচার, হুন্ডি ব্যবসা আর হুমকি-ধমকিতে সাড়ে ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা হুন্ডি সুমন। পেটোয়া বাহিনী গড়ে তুলে হয়েছিলেন অপরাধ চক্রের এক কুখ্যাত গডফাদার। জ্ঞাত আয়ের বাইরে সুমনের ব্যাংক হিসাবে মিলেছে ৪৬৫ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য। রেলের জমিতে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ, শহরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ছয়টি আলিশান ভবন, সঞ্চয়পত্র, চাতাল, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন সুমন। শুরু করেন হুন্ডি-মাদক কারবার, গরু পাচার, জমি দখল, অস্ত্রের মুখে চাঁদাবাজি। বিশেষ করে গত সাড়ে ১৫ বছরে হয়েছেন অঢেল অবৈধ সম্পদের মালিক। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, হাজির করা হতো সুমন খানের বিডিআর গেট কালিবাড়ীতে অবস্থিত খান হোটেলে। পরে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হতো। সুমনের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৪৬৫ কোটি টাকা ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য পায় সিআইডি। তার নামে হত্যা, চাঁদাবাজি, দখলসহ ১৬টি মামলা আছে বলে জানিয়েছেন সদর থানার ওসি মোহাম্মদ নুরনবী।

অবশেষে ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর পালিয়ে যাওয়ার সময় তিস্তা সড়ক সেতুর টোল প্লাজা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি লালমনিরহাটে কারাগারে আছেন। ইতোমধ্যে হুন্ডি সুমনের স্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছে জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

লালমনিরহাট শহরের কালিবাড়ী এলাকার মনছুর আলী বলেন, আওয়ামী লীগের সময় সুমন খান দুর্নীতির উৎসবে মেতেছিলেন। তার অবৈধ আয়ের টাকার ভাগ পেতেন দলের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। তার অধিকাংশ সম্পদ স্ত্রী ও স্বজনদের নামে।

লালমনিরহাট জজ আদালতের পিপি হুমায়ুন রেজা স্বপন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় বিরোধী মত দমনে শত শত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রত্যাহারের জন্য ৯১টি মামলার তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮৭টি প্রত্যাহার হয়েছে। অন্যগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে।

ছাত্রদলের সাবেক জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন আহম্মেদ লিমন বলেন, আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়েছি। অন্তত দুই ডজন মামলা কাঁধে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমাদের ১১ সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। এমনকি জুলাই বিপ্লবেও লালমনিরহাটের ৯ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। বিএনপিদলীয় কার্যালয়সহ অসংখ্য নেতাকর্মীর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক রেজানুর রহমান রেজা বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের সময় শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতেও সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ফেলানীর নির্মম মৃত্যু উল্লেখযোগ্য। আজও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি তার পরিবার। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্র বানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

তিনি আরো বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে আলেম-ওলামাদেরও অমানসিক জুলুম, নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি ইসলামের দাওয়াতি মাহফিলেও হামলা চালানো হয়। অনুমতি নিয়ে মাহফিল করলেও বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও নানা শর্তারোপ করা হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সংগঠক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘জুলাই গণহত্যা ও বাংলাদেশের পুনর্জন্মের এক বছর পেরিয়ে গেলেও হাজারো শহীদ ও আহত-পঙ্গুর রক্তের ওপর ক্ষমতার মসনদে বসা অন্তর্বর্তী সরকার রক্তপিপাসু এবং গণহত্যার নির্দেশদাতা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমরা দ্রুত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই। জুলাই গণহত্যা ছাড়াও গত সাড়ে ১৫ বছরে খুনি শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী কায়দায় যেসব গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন, তারও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’

জেলা বিএনপির সহসভাপতি রোকন উদ্দিন বাবুল বলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা ছিল তার নেওয়া কৌশলগুলোর অন্যতম। এ অপচেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে দেড় দশকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে শত শত গায়েবি মামলা দিয়ে তাদের বাড়িছাড়া করেছিল। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট ফিরোজ হায়দার লাভলু বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি জুলুম নির্যাতন হয়েছে ইসলামপন্থিদের ওপর। সে ক্ষেত্রে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ছিলেন প্রধান টার্গেট। গুম-খুনের পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। আমাকেও তিনবার জেলে নেওয়া হয়।’

লালমনিরহাট জেলা জামায়াতের আমির আবু তাহের বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের সবচেয়ে বড় বাধা মনে করত ফ্যাসিবাদীরা। এ জন্য অত্যাচার নির্যাতনও বেশি হয়েছে। আমাদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। কোনো নেতাকর্মী বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতেও পারেননি। অনেক সময় বাড়িতে নেতাকর্মীদের খুঁজে না পেলে পরিবারের অন্য সদস্যদের হয়রানি করত। তুলে নিয়ে জঙ্গিনাটক সাজানো হতো। এভাবে পুরো জেলাকে ভয়ভীতির রাজ্যে পরিণত করেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু তাদের বিচার নিয়ে দেশে যা হচ্ছে তা জনগণকে হতাশ করছে। একই সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনে সেই ফ্যাসিবাদের দোসরদের বসিয়ে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়, যা কখনো সম্ভব নয়।

বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না। একেকজন নেতাকর্মীর নামে শত শত মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশটাকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। প্রতিবেশী দেশটির সহায়তায় আওয়ামী লীগ টানা দেড় দশক অত্যাচার ও গুম-খুন করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা চালান। বছরের পর বছর মানুষ শেখ হাসিনার মাধ্যমে অত্যাচারিত হয়েছে। এ কারণে মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। নানা কালাকানুন দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সত্য উচ্চারণ করলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত