সাথী ফসলে সফল উদ্যোক্তা লাজু পথ দেখাচ্ছেন অন্যদেরও

উপজেলা প্রতিনিধি, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৫, ১৩: ৫০

শুরুতে অনেকে নিষেধ করেছিল, লোকসানের ভয় দেখিয়েছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে অন্য ব্যবসার পাশাপাশি পৈতৃক জমিতে গড়ে তুলেছেন খামারবাড়ি। বর্তমানে ৭৭ শতক জমিতে ২৩০টি গৌরমতি আম গাছের মাঝে মাঝে সাথী ফসল হিসেবে ৬০০ পেয়ারা গাছ, ৭৫শতক জমিতে ৩৬০টি বারি-৪ আম গাছ এবং ১হাজার ২শ বস্তায় আদা চাষ, ২০ শতক জমিতে ৪৬ টি শরিফা (নেওয়া) গাছ এবং সাথী ফসল হিসেবে ১৬১টি পেপে গাছ, ২০০টি বরই গাছের একটি বাগান ও কলা বাগান লাগিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

একই সাথে একটি গরুর খামার করেছেন সেখানে রয়েছে ৬টি গরু। ৩০ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে লাগিয়েছেন কচুলতি। সব মিলিয়ে কৃষি থেকেই তার বাৎসরিক আয় আট থেকে দশ লাখ টাকা।

চাকরির পেছনে না ছুটে জমিতে নানা ধরনের শাকসবজিসহ সাথী ফসল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। মাত্র তিন বছরে বদলে গেছে তার জীবন। নিজেকে এলাকার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলে এখন পথ দেখাচ্ছেন এলাকার বেকার নারী পুরুষদের।

বলছি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের সাবেক সেনা কর্মকর্তা আকবর আলীর ছেলে তৈয়বুর রহমান লাজু (৪৮)’র কথা। বাবার অবসরে পর সংসারের হাল ধরতে এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার পাশাপাশি হয়ে উঠেন কৃষি উদ্যোক্তা।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার দৌলতপুরে নিজ জমিতে কাজ করছেন উদ্যোক্তা লাজু। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তার বাগানের অদ্যপান্ত ঘুরিয়ে দেখান। প্রত্যন্ত গ্রামে তার সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনান তিনি।

লাজু পরীক্ষামূলকভাবে নিজের ৩০ শতাংশ জমিতে চাষ করেছেন কচুর লতি। এতে খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ হাজার টাকার লতি বিক্রি করেছেন। আরও ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার লতি বিক্রি হবে। এছাড়া লতি উৎপাদন শেষে অবশিষ্ট কচু গাছগুলো বিক্রি হবে এবং জমি থেকে ওই গাছগুলো তোলার পর যে চারা গজাবে, সেই চারাও বিক্রি হবে। ফুলবাড়ী বানিজ্যিকভাবে প্রথম কচু চাষ শুরু করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রথমে যখন লতি চাষ শুরু করি, এলাকার অনেক কৃষক আমাকে বলেছিল এই ফসল আমাদের এলাকায় তেমন কেউ করে না। এতে অনেক ঝামেলা এসব করে কি হবে। এ নিয়ে অনেকেই নিরুৎসাহিত করে। তবুও থেমে থাকিনি, আমার তিব্র ইচ্ছা লতি চাষ করবই। এখন আমার দেখাদেখি অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন।

এই চাষি আরও জানান, কচুর লতি চাষ করলে বছরের ৭-৮মাস মাস তোলা যায়। জমিতে বীজ ফেলার দুই মাসের মাথায় লতি তুলে বাজারে বিক্রি শুরু করা যায়। সপ্তাহে দুইদিন লতি তুলতে হয়। প্রতি সপ্তাহে ৬-৭মণ কচুর লতি উঠে জমি থেকে। সেগুলো পানিতে ধুয়ে ওজন করে আঁটি বেঁধে বাজারে নিয়ে যাই। প্রতি মণ কচু পাইকারি বিক্রি হয় ১২-১৫শ’ টাকায়।

লাজু বলেন, তার এই কাজে সহযোগিতা করেনে তার স্ত্রী তৌহিদা বেগম, ছেলে তৌফিক এলাহী। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর থেকে পরামর্শসহ বিভিন্নভাবে তাকে সহযোগিতা করেন। তিনি পরবর্তীতে আরও এক একর জমিতে কচুর লতি চাষ করতে চান।

লাজু বলেন, আমরা যারা পড়াশুনা শেষ করে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি খুঁজছি। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে ভালো কিছু করতে পারি। এতে স্বাধীন ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।

শুধু লতি নয় এর পাশাপাশি তিনি ৭৭শতক জমিতে সাথী ফসল হিসেবে ২৩০টি গৌরমতি আম গাছের মাঝে মাঝে ৬০০ পেয়ারা গাছ লাগিয়েছেন। গাছ গুলোতে থোকায় থোকায় আম ও পেয়ারা এসেছে। এর মধ্যে কিছু বিদেশি উন্নত জাতের আমও রয়েছে। আরেকটি ৭৫ শতক জমিতে ৩৬০টি বারি-৪ আম গাছ এবং ১হাজার ২শ বস্তায় আদা চাষ করেছেন। চলতি মৌসুমে ওই বাগান থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার আম বিক্রির আশা করছেন। অন্য একটি ২০ শতক জমিতে ৪৬ টি শরিফা (নেওয়া) গাছ লাগিয়েছেন, সেখানে সাথী ফসল হিসেবে লাগানো ১৬১টি পেপে গাছে ফল এসেছে। ২০০টি বরই গাছের একটি বাগান ও কলা বাগান লাগিয়েছেন। এভাবে একই জমি ব্যবহার করে কয়েকটি ফসল ফলানো হচ্ছে। পাশাপাশি একটি গরুর খামার করেছেন, সেখানে ৬টি গরু রয়েছে। যার গোবর থেকে ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার এই চাষাবাদ দেখে শুধু পুরুষরাই নয় এলাকার নারীরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।

লাজুর দেখাদেখি দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য নুরবানু তার বাড়ির পাশে ২০শতক জমিতে মাল্টা, আম বাগানসহ পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তুলেছেন। বাগানে গাছের মাঝে ২শ বস্তা আদা চাষ করেছেন।

সাবেক ইউপি সদস্য নুরবানু বলেন, লাজু ভাই আমার প্রতিবেশী তার দেখাদেখি আমিসহ অনেকেই কৃষিতে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করছি। তার পরামর্শে কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বাগান করেছি এবং ভার্মিকম্পোষ্ট সারের জন্য হাউজ তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। একই কথা বলেন ওই এলাকার কৃষক আবুল কালাম ।

এলাকার তরুণ কৃষকদের নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুকে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। সেখানে তারা বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করেন। এদিকে কৃষিকাজের পাশাপাশি তিনি ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবেও কাজ করে সফলতা পেয়েছেন। জমিতে ফসল ফলানোসহ সকল কাজের ভিডিও ধারণ করে তা নিজের ফেইসবুক প্রফাইলে আপলোড করে সেখান থেকেও আয় করতে শুরু করেছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শাহানুর রহমান বলেন, ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে তৈয়বুর রহমান লাজু একজন ভালো কৃষি উদ্যোক্তা। ইতিপূর্বে কৃষি কর্মকর্তাসহ তার প্রজেক্ট গুলো পরিদর্শন করেছি। সাথী ফসল এবং যৌথ বাগান একটি লাভজন ফসল। এটি করলে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার হয় এবং উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে এটি অত্যন্ত লাভজনক হয়। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ আমরা তাকে সব রকম পরামর্শসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত