চাহিদা মত ঘুষের টাকা না দেওয়ায় নিরপরাধ দুই ব্যক্তিকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। ঘটনাটি রংপুরের গঙ্গাচড়া মডেল থানার। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে।
রংপুরের গংগাচড়ায় পরকীয়া প্রেমের বলি শুকতারা হত্যা মামলার তদন্তকে কেন্দ্র করে থানারই সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) উত্তম কুমার রায়ের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অনিয়ম, ঘুষ দাবি ও তদন্তে নিরপরাধ দুই ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগকারী পরিবার জানিয়েছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর উত্তম কুমার রায় দাবি করেছিলেন দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে হত্যা মামলায় আসামি করা হবে। ঘুষের দাবি ও হুমকির ফোন কথোপকথনের ‘অডিও’ রেকর্ড দৈনিক আমার দেশ এর কাছে রয়েছে, যা বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করছে।
ঘটনাটি হল, মণ্ডলের হাট গ্রামের বাসিন্দা মাহাবুব হাসান বল্টু (৪০) দীর্ঘদিন ধরেই মাদকাসক্ত ছিলেন। তার স্ত্রী শুকতারা বেগম (৩৫) এক যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হওয়ায় দম্পতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মনোমালিন্য চলছিল। ২০২৪ সালের ৪ জুন রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তর্ক বাঁধে। মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়ে মাহাবুব তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেন। ঘটনার সময় মাহাবুবের মা আশরেফা সরকার (৫৮) ও নাতি মাসুক হাসান সরকার অপূর্বকে (১৪) নিয়ে তার মেয়ে মৌসুমি আক্তার মিতু (২৮)-এর বাড়িতে ছিলেন। হত্যার পর মাহাবুব পালিয়ে যান, তবে পরের দিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
৬ জুন ২০২৫ তিনি রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাসিনুর রহমান মিলন-এর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে সে স্বীকারোক্তিতে বলেন যে, আলামিন নামে একটি ছেলের সাথে স্ত্রী শুকতারা বেগম পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এ নিয়ে সে স্ত্রীকে এই সম্পর্ক থেকে সরে আসতে কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পুনরায় তার ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
জবানবন্দিতে আরও জানায়, ঘটনার রাতে তার মা, বোন, ছেলে রংপুর নগরীতে ছোট বোনের শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন। আমরা স্বামী-স্ত্রী একা বাড়িতে ছিলাম। রাতে আমি স্ত্রী শুকতারা বেগমকে দেখি সে গভীর রাতে আলামিনের সাথে মোবাইলে কথা বলছে। এ নিয়ে আমাদের দু’জনের মাঝে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায় জানায় সে আলামিনের সাথে চলে যাবে। আমি এ সময় নেশাগ্রস্ত থাকায় স্ত্রীর গলা চিপে ধরি, পরে দেখি সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যাই। পরের দিন বাড়িতে ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের সময় মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, গঙ্গচাড়া মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর জিল্লুর রহমান, এর পরে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন একই থানার সাব-ইন্সপেক্টর উত্তম কুমার রায়।
তিনি মামলার তদন্তভার গ্রহণ করার পরে থেকে খুনের দায়ে কারাগারে আটক মাহাবুব হাসান বল্টুর ছোট বোনের স্বামী চঞ্চল মাহমুদ এর সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। এর পরে তাকে প্রস্তাব দেন পুলিশের এসপি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসিকে টাকা না দিলে মামলায় তার স্ত্রী ও শাশুড়িকে আসামি করা হবে। মামলার এজাহারে নাম থাকলেও তদন্ত করে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই এই মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ আছে। সে কারণে ৩ লাখ টাকা তিনি দাবি করেন।
ঘুষ সংক্রান্ত কথোপকথনের অডিওতে শোনা যায়, চঞ্চল মাহমুদ বলেন, আমি চঞ্চল মাহমুদ রংপুর থেকে বলছি। ভাই কি করা যায়?
তখন ফোনের অপরপ্রান্তে ওই পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় বলেন, কি করা যায় আমি তো সর্বোচ্চ বিবেক থেকে বলছি।
চঞ্চল মাহমুদ: অতবড় টাকা তো ভাই বেশি হয়ে যায়, আমার সামর্থের বাইরে, দয়া করনে ভাই।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা: দেখেন আসলে আপনাকে বলছি এখানে আমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। এছাড়া একটা বড় মামলার ব্যাপারে যখন বড় কিছু হয় তখন সবার চোখ থাকে।
চঞ্চল মাহমুদ: তারপরও ৩ লাখ টাকা অনেক বেশি হয়ে যায়। তাছাড়া এরা তো দোষি নয়।
তদন্ত কর্মকর্তা: দোষী নয় বলেই টাকা দিতে হবে। দোষি হলে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে আপনাকে এই টার্গেট দিছি, আপনার টার্গেট কি রকম বলেন শুনি, আপনার ইয়া কত?
চঞ্চল মাহমুদ: ১ লাখ টাকা দেই ভাই। আমাদের দেখে মনে হয় অনেক কিছু আসলে তেমন টাকা পয়সা নাই। আমি এখনো আমার শাশুড়িকে জানাইনি।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা: না ভাই আমি কোনো দিকই সামাল দিতে পারবো না। আচ্ছা শোনেন আপনাকে ফাইনাল বলছি দামাদামি করতে পারব না। আপনি “টু-ফিফটি” (দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার) দিলে আমি সবদিকে যা পারি দেই, ম্যানেজ করে নিতে পারব। তা ছাড়া আমি সামাল দিতে পারব না। এর নীচে কম দিলে হবে না, পারব না। আমাকে উপর থেকে বারবার চাপ দিচ্ছে মামলার চার্জশিট দিতে। যা করবেন আজকের ভেতরে করেন। না হলে কালকে চার্জশিট জমা দিব আমার হাতে সময় নাই।
এছাড়া সরেজমিনে দেখা যায়, গঙ্গাচড়ার মণ্ডলের হাট এলাকার মামলা সাক্ষী খোরশেদ আলমের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাকে মামলা সাক্ষী হিসেবে দেখানো হলেও তিনি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তাকে দিনমজুর দেখানো হলেও তিনি আলমবিদিতর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হিসেবে ১৫ বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তিনি এলাকায় গৃহস্থ মধ্যবিত্ত পরিবার। তাকে দিনমজুর বলায় তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
একইভাবে অপর সাক্ষী আনিছুর রহমানকে কৃষক বলে পরিচয় দিয়ে তার সাক্ষীর বক্তব্য তুলে ধরা হলেও তার সাথে ওই পুলিশ কর্মকর্তার কোনো কথা হয়নি বলে তিনি জানান। পেশায় তিনি ফার্মাসিস্ট, তার ওষুধের ব্যবসা রয়েছে।
স্থানীয় গ্রাম পুলিশ মনমোহন রায় মন্টুকে মামলায় সাক্ষী করা হলেও তিনি বলেন, এই মামলায় তিনি কি করে সাক্ষী তা নিজেই জানেন না। অথচ তাকে সাক্ষী করে তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশের কর্মকর্তারা অনেক সময় গ্রাম পুলিশের নানা সময়ে বিভিন্ন কাগজে নাম স্বাক্ষর নেন। কিন্তু এই মামলার সাক্ষী হিসেবে আমি ছিলাম না।
অপর সাক্ষী বিউটি বেগম, তার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২ মাইল দূরে। তাকে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। তিনি মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। একইভাবে প্রতিবেশি রুপালী বেগম(৫০), লিপি আক্তার’সহ মামলার একাধিক সাক্ষীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা এই মামলায় পুলিশের কাছে কোনো সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন নাই।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর উত্তম কুমার রায় সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা বানোয়াট ভিত্তিহীন । তাদের পক্ষে না বলার কারণে তারা মিথ্যা অডিও রেকর্ড ছড়াচ্ছেন। এটাই আমার বক্তব্য।
গঙ্গচাড়া মডেল থানার ওসি আল এমরান এর কাছে এই ঘুষের টাকা দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার নিজস্ব বিষয়। এখানে কেউ বাণিজ্যে জড়িত হলে তার শাস্তি হবে। আমার থানার কোনো পুলিশ সদস্য তা করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চই দেখবেন।
এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মারুফত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নতুন আসায় কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

