টানা দরপতনে শেয়ারবাজার বিপর্যস্ত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩৫

টানা দরপতনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। গতকাল রোববার চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের পতন হয়েছে ৬৮ পয়েন্টের, শতকরা হিসাবে পতনের এ হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এ নিয়ে টানা ছয় কার্যদিবসে সূচকের পতনে শেষ হলো লেনদেন। এ সময়ে সূচকের পতন হয়েছে ২২৩ পয়েন্ট। ফলে ডিএসই সূচক দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৯৯ দশমিক ৯২ পয়েন্টে। এটিই গত চার মাসের মধ্যে ডিএসই সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে গত ৭ জুলাই ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৪ হাজার ৯৭৬ পয়েন্টে।

বিজ্ঞাপন

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ, নতুন মার্জিন বিধিমালা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাজারে প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে ইসলামী ধারার পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার শূন্য ঘোষণার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থার জন্য তারা দায়ী না হলেও শেয়ার শূন্য করে তাদের ‘শাস্তি’ দেওয়া হচ্ছে।

ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংক এক্সিম, সোশ্যাল, গ্লোবাল, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ এবং ইউনিয়ন ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে নতুন সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। আর্থিকভাবে দুর্বল এসব ব্যাংকের শেয়ার শূন্য ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বড় ধরনের নেগেটিভ ইক্যুয়িটির কারণে এসব ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবে না।

এদিকে ব্যাংকগুলোর শেয়ার শূন্য ঘোষণার প্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ৬ নভেম্বর থেকে পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন স্থগিত ঘোষণা করে। ব্যাংকের শেয়ার শূন্য ও লেনদেন স্থগিত করার প্রতিবাদে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। গত ৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি এবং দাবি পূরণ না হলে ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে কমছে লেনদেনের পরিমাণও। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৪০২ কোটি ২০ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন আমার দেশকে বলেন, ইসলামী ধারার ৫টি ব্যাংকের একীভূতকরণ ইস্যুতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। কারণ তারা হয়তো মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তবে তার মতে, ব্যাংকগুলো একীভূতকরণে আইনের কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। যে পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ করা হচ্ছে সেগুলোর ইক্যুয়িটি বড় ধরনের ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। ফলে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই।

গত কয়েকদিন ধরে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণের সঙ্গে বিএসইসির নতুন মার্জিন বিধিমালা ইস্যু শেয়ারবাজার পতনে ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক।

তিনি বলেন, মার্জিন লোন নিয়ে শেয়ারবাজারে এক ধরনের কারসাজি করা হতো। কিন্তু নতুন বিধিমালায় কারসাজির সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতে মার্জিন লোন সুবিধার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে মার্জিন নিয়ে বাজারে যারা কারসাজি করত, এখন তারা বাজারে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করছে।

এদিকে বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী আমার দেশকে বলেন, পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণে এসব ব্যাংকের শেয়ার শূন্য করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, সেটি দুঃখজনক। কিন্তু এসব ব্যাংক যারা ধ্বংস করেছে, তাদের সেফ এক্সিট দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও প্রাইম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, রাজনৈতিক সংকট, নতুন মার্জিন বিধিমালা এবং একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার শূন্য ঘোষণা এবং লেনদেন স্থগিত রাখার প্রভাব পড়ছে বাজারে। জুলাই সনদ নিয়ে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব এবং আগামী ১৩ নভেম্বর পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় নিয়ে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এছাড়া নতুন মার্জিন লোনের ক্ষেত্রে প্রস্তাবনার তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করলেও বেশ কিছু শর্তের কারণে মার্জিন সিকিউরিটিজের সংখ্যা আগের তুলনায় কমছে। ফলে যেসব কোম্পানির শেয়ার মার্জিন সুবিধার আওতার বাইরে চলে গেছে সেসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রির চাপে বাজারে পতন হয়েছে।

সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সিইও মীর আরিফুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, শেয়ারবাজারে দরপতনে বিএসইসির নতুন মার্জিন বিধিমালার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। নতুন মার্জিন বিধিমালায় জাঙ্ক শেয়ারে অর্থায়নের পথ বন্ধ করে দেওয়ার কারণেও বাজারে তার প্রভাব পড়ছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল দিনের শুরুতেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর কমে যায়। দর কমার এ প্রবণতা লেনদেনের শেষ অবধি বজায় থাকায় আগের দিনের তুলনায় ৬৮ পয়েন্টের পতন ঘটে। এ দিন লেনদেনে অংশ নেওয়া ইস্যুগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৪টির দর বেড়েছে। অপরদিকে কমেছে ৩২৯টি ইস্যুর এবং অপরিবর্তিত ছিল ২৭টির দর।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত