আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ছয় সুগার মিল চালুর ঘোষণা শুধু কাগজেই

কাওসার আলম

ছয় সুগার মিল চালুর ঘোষণা শুধু কাগজেই

আওয়ামী আমলে বন্ধ করে দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি চিনিকল চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এক বছর আগে ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এমনকি বিষয়টি নিয়ে সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দের জন্য আবেদন জানানো হলেও সাড়া মিলছে না অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অধীনে নেওয়ার বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

বন্ধ মিল চালুর ঘোষণায় মিলগুলোতে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক, আখচাষিসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পার হলেও মিলগুলো চালুর উদ্যোগ না থাকায় তাদের মধ্যে বড় ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ, রংপুর, পঞ্চগড়, পাবনা ও কুষ্টিয়ার ছয়টি চিনিকলের আখ মাড়াই স্থগিত করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এতে চিনির উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ কারণে ২০২২-২৩ মৌসুমে মাত্র ২১ হাজার ৩১৪ টন চিনি উৎপাদন করে মিলগুলো। উৎপাদন কম হওয়ার সুযোগ কাজে লাগায় রিফাইনারি মিলগুলো। ৬০ টাকা কেজি দরের চিনি ১৪০-১৫০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। ছয়টি চিনিকল বন্ধ হওয়ায় বর্তমানে ৯টিতে চিনি উৎপাদন হচ্ছে।

জানা গেছে, মিলগুলো বন্ধ করে পাঁচ বছরের মাথায় আধুনিকায়নের নামে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কাছে তুলে দেয় আওয়ামী সরকার। কিন্তু জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সে চুক্তি বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বন্ধ মিলগুলো চালুর বিষয়ে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্স গত বছরের নভেম্বরে প্রতিবেদনও দেয়। সে প্রতিবেদনে পর্যায়ক্রমে মিলগুলো চালুর বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।

টাস্কফোর্সের সুপারিশে মিলগুলো চালুর বিষয়ে প্রশাসনিক অনুমোদন, পর্যায়ক্রমে মাড়াই কার্যক্রম চালুতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রদান, চিনিকলগুলোর পুঞ্জিভূত ঋণ, দায়দেনার সঙ্গে ট্রেড গ্যাপের সমন্বয়, চিনিকলগুলো লাভজনক করতে উচ্চফলনশীল আখ চাষ, চিনির উপজাতভিত্তিক পণ্য উৎপাদন, দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ এবং মিলগুলোর আধুনিকায়নে সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে বিএসএফআইসির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টাস্কফোর্সের এসব সুপারিশ ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে।

জানা গেছে, টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে ২০২৪-২৫ মাড়াই মৌসুমে শ্যামপুর সুগার মিলের জন্য ৩১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের জন্য ৩১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন। কিন্তু সে আবেদনে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।

বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রশিদুল হাসান আমার দেশকে বলেন, টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে বন্ধ চিনিকল চালুর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ চাওয়া হলেও অনুমোদন মেলেনি।

এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্ধ মিল চালুতে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না এবং বন্ধ মিল চালুর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো কনসেন্টও নেওয়া হয়নি। এদিকে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় মিলগুলো চালুর বিষয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

অবশ্য গত ৫ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধনকালে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ফান্ড সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে জানান। তিনি বলেন, ফান্ড পাওয়া গেলে মিলগুলো চালু করা হবে। তবে কোথা থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা হবে, সে বিষয়ে তিনি কিছু উল্লেখ করেননি।

জানা গেছে, ট্রেড গ্যাপ ও ভর্তুকি বাবদ শ্যামপুর সুগার মিল ৪৫২ কোটি টাকার বেশি এবং সেতাবগঞ্জ সুগার মিল ৪৮৪ কোটি টাকার বেশি সরকারের কাছে পাওনা আছে। বিভিন্ন সময় করপোরেশনের পক্ষ থেকে সে অর্থ চাওয়া হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় তাতে সায় দিচ্ছে না। শ্যামপুর সুগার মিলের ব্যাংকঋণ ও দায়দেনার পরিমাণ ২৬৪ কোটি টাকা এবং সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের ৩০৮ কোটি টাকা। একদিকে সরকারের কাছ থেকে পাওনা না পাওয়া, অন্যদিকে ব্যাংকঋণের কারণে আর্থিক সংকটের মুখে আছে করপোরেশন।

এদিকে বন্ধ হওয়া কুষ্টিয়া সুগার মিলকে বেজায় হস্তান্তরের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেজার পক্ষ থেকে মিলের জায়গা, জমিসহ সব ধরনের উপকরণের ইনভেন্টরি সম্পন্ন করেছে বেজা। মিলটি হস্তান্তরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মেজর জেনারেল (অব.) নজরুল ইসলাম কুষ্টিয়া সুগার মিলের ইনভেন্টরি প্রতিবেদন সম্পন্ন করার কথা জানিয়ে আমার দেশকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত বেজার গভর্নিং বোর্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে এটি। কুষ্টিয়ার মিলটি বিদ্যুৎ, পানির প্রতুলতাসহ অবকাঠামোগত বিবেচনায় এটি বিনিয়োগের জন্য খুবই অনুকূল অবস্থায় আছে। বিশেষ করে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কুষ্টিয়া সুগার মিল বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময়।

তবে কুষ্টিয়া সুগার মিলকে বেজার কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএসএফআইসি। সংস্থাটির সচিব মুজিবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, কুষ্টিয়া চিনিকল বেজায় হস্তান্তরের বিষয়ে আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। সরকার এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। বেজার পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন