বাজেটের ধাক্কায় পোলট্রি খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৫, ০৯: ১৬

দেশের প্রাণিজ আমিষের ৪০ শতাংশ চাহিদাই পূরণ করে থাকে পোলট্রি খাত। গ্রামীণ জনগাষ্ঠীর কর্মসংস্থান তৈরিতে এ খাতটির রয়েছে বড় ধরনের ভূমিকা।

কিন্তু আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা প্রত্যাহারের পাশাপাশি প্রায় শতভাগ টার্নওভার ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যমান রয়েছে আমদানিতে উচ্চহারে উৎসে কর। ফলে আগামীতে পোলট্রি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

বিজ্ঞাপন

তারা বলছেন, সরকারের এ ধরনের কর ব্যবস্থা পোলট্রি খাতের বিকাশের পথেই শুধু বাধা হিসেবেই কাজ করবে না, বরং এ খাতটি বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে দেশের পোলট্রি খাতের করপোরেট কর হার ছিল ১৫ শতাংশ। এ খাতের বিকাশ ও গ্রামীণ বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা থাকায় কর রেয়াত সুবিধা ভোগ করে আসছিল খাতটি। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে কর রেয়াতের এ সুবিধা থাকছে না এ খাতে। ফলে এ খাতের কোম্পানিগুলোকে সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। একলাফে প্রায় দ্বিগুণ হারে করবৃদ্ধির পরিবর্তে তা ধাপে ধাপে বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা। ১৫ শতাংশ থেকে তা বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার দাবি জানান তারা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আহ্বায়ক শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, এ খাত বর্তমানে নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে এ ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। অতীতে কর রেয়াত সুবিধার কারণে এ খাতের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটতে পারেÑএমন সম্ভাবনার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু তাদের কারণে অন্যদের শাস্তি দেওয়াটা ন্যায্য হবে না।

এদিকে বাজেটে টার্নওভার ট্যাক্স ০.৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে এ খাতে বড় ধরনের ধাক্কা পড়বে বলে মনে করছেন ওয়ার্ল্ড পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি মসিউর রহমান। তিনি বলেন, বাজেটে এ ধরনের কর বৃদ্ধির কারণে পোলট্রি খাতটি থমকে যেতে পারে। এতে খাদ্যনিরাপত্তাও বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন ডিম ও মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ডিম আমদানি করা যায় না। অতীতে জোর করে আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ভালোভাবে চিন্তা করে তা করা হয়নি। পোলট্রি খাত বিকাশে সরকারের কাছ থেকে নীতিগত সহায়তা দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, টার্নওভার ট্যাক্স ০.৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে উন্নীত করা হলে প্রকৃতপক্ষে কর হার দাঁড়াবে ৪৫ শতাংশে। সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর হারের চেয়েও এ হার অনেক বেশি। বছর শেষে অতিরিক্ত কর সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেটি হয় না। সমন্বয় না করায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বিপুল অংকের অর্থ আটকে আছে বলে তাদের দাবি।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সহ-সভাপতি এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, এ খাতে প্রফিট মার্জিন ২ থেকে ৩ শতাংশ। এখন ১ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্সের কারণে এতে একটা বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে। এ কারণে টার্নওভার ট্যাক্স কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, করের হার বাড়লে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খামরিরা সাধারণত ব্যাংক থেকে লোন পান না। গ্রামের অনেক বেকার যুবক পোলট্রি খামারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব থাকায় ব্রিডার ও ফিড মালিকরা বাকিতে খামারিদের মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য সরবরাহ করে। করের বোঝা বাড়লে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খামারিদের ওপর। খামারিরা না বাঁচলে এ খাতও বাঁচবে না বলে আশঙ্কা তাদের।

এদিকে পোলট্রি শিল্পের অত্যাবশ্যক কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। এটিকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা উচিত বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বর্তমানে আধুনিক অনেক খামার গড়ে উঠেছে। আন্তজার্তিক মানদণ্ড বজায় রেখে এসব খামার তৈরিতে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। কিন্তু এসব যন্ত্রপাতির ওপর ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হয়। শুল্ক হার যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সম্প্রতি চাহিদার তুলনায় মুরগির বাচ্চা উৎপাদন অনেক বেড়ে যাওয়ায় হ্যাচারি মালিকরা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ এক কোটি ৭০ লাখ বাচ্চার চাহিদার বিপরীতে দুই কোটি ৪০ লাখের মতো উৎপাদিত হচ্ছে। বাড়তি এ উৎপাদনের কারণে হ্যাচারি খামারিরা ১০ টাকায় বাচ্চা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এসব বাচ্চা উৎপাদনে ৪০ থেকে ৪২ টাকা খরচ হয়। সরকার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য ৫৮ টাকা হলেও তারা বাধ্য হয়েই অনেক কম দরে বাচ্চা বিক্রি করছেন। এ কারণে প্রতি সপ্তাহে ৭৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে সরকারের নীতিমালা থাকলেও সেটি কেউ অনুসরণ করছে না। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

খাত সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, বাচ্চার দাম কমে যাওয়ার কারণে ব্রয়লারের দামও কমছে। প্রতি কেজি ব্রয়লারের পাইকারি মূল্য ১০৫ টাকায় নেমে এসেছে। অথচ তাদের উৎপাদন খরচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। ফলে খামারিরাও লোকসান গুনছে। কিন্তু যারা ট্রেডার তারা ঠিকই মুনাফা করছে বলে তারা জানান। খামারিদের বাঁচিয়ে এ খাতকে রক্ষা করা না গেলে আগামী দিনে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করছেন তারা। করের হারের যৌক্তিকীকরণের পাশাপাশি এ খাতের জন্য নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত