২০০ বছরের ঔপনিবেশিক মুক্তির ৭৮ বছর, যে ইতিহাস বলা হয় না

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩৯
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ২২: ১৬

১৯৪৭ সালের এই দিনে ভারতবর্ষের মুসলমানরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিল, যা ছিল দুই শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির দিন। কিন্তু আমাদেরকে সেই ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। অথচ আমাদের শেখানো হয়- হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস শুরু হয়েছে বায়ান্ন থেকে"- ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল মুক্তির ৭৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে "ফিরে দেখা আজাদি" শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর।

বিজ্ঞাপন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম মনজুর মনে করেন, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ইতিহাসে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বরং দক্ষিণ এশিয়ায় তার রাজনীতিক অবদান অসামান্য। মূলত জিন্নাহ-গান্ধীদের নেতৃত্বেই দুইশত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটেছিল।

তিনি বলেন, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে অনেকেই সাম্প্রদায়িক তত্ত্ব আখ্যা দিয়ে ফেলেন। তৎকালীন মুসলিম নেতাদেরকে সাম্প্রদায়িক নেতা বলে উপাধি দিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে পড়াশোনা না করে এসব বিষয়ে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা যাবে না। মন্তব্য করার পূর্বে ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরো পৃথক এবং বঞ্চিত জাতিসত্তার জন্য লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন জিন্নাহ। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। সুতরাং ইতিহাস থেকে সাতচল্লিশকে মুছে ফেলা যাবে না। "জিন্নাহ, আল্লামা ইকবালরা ছিলেন মুসলমানদের রাজনৈতিক মুক্তির ধারাবাহিক সংগ্রামের মূল প্রেরণা," বলেন তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. বিলাল হোসাইন বলেন, "ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় শুধু রাজনৈতিক দখলই নেয়নি, বরং হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে মিলে একটি 'দ্বৈত উপনিবেশ' তৈরি করেছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরসহ নানা দুর্ভিক্ষ ছিল তাদের শোষণনীতির ফল।"

লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মনোচিকিৎসক ডা. ফাহমিদ-উর-রহমান বলেন, "আজকের দিনে আমরা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাইনি, মুসলিম জাতিসত্তার স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলার মুসলমানদের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"

তিনি ইতিহাসবিদ মোহর আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন শুধু নবাব পরিবারের পতন ছিল না, বরং ইউরোপের কাছে সমগ্র এশিয়ার পরাজয় ছিল।

ডা. ফাহমিদ-উর-রহমান আরও বলেন, "৪৭-কে যারা অস্বীকার করে, তারা আসলে বাংলাদেশের জন্মকেও অস্বীকার করে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে শুধু জিন্নাহ বা নবাব সলিমুল্লাহর দায় হিসেবে দেখা ভুল। উনিশ শতকের হিন্দু মেলা, শিবাজী উৎসব, অনুশীলন, যুগান্তরের মতো হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিগুলোও দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ বপন করেছিল।"

বক্তারা আরও বলেন, ১৯৪৭ সালের আজাদির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবিজয় থেকে ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিপাহি বিদ্রোহ, সাতচল্লিশ, একাত্তর ও চব্বিশের সংগ্রাম—সবই এই অঞ্চলের মানুষের শোষণবিরোধী ধারাবাহিক লড়াইয়ের অংশ।

আলোচনা সভায় বক্তারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে ‘ফিকশন’ বা পক্ষপাতদুষ্ট বর্ণনা থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানান এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও হেজিমনির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত