আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১

শহীদ জুনায়েদের মায়ের সঙ্গে অঝোরে কাঁদলেন সবাই

সাইদুর রহমান রুমী
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ০২

রাজধানীর চানখাঁরপুলে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে শহীদ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল সাক্ষ্য দিয়েছেন। গতকাল বুধবার তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেন। এ সময় তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। জড়িয়ে যাচ্ছিল তার কথাবার্তা। তার এমন নাজুক অবস্থা দেখে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ভারী হয়ে ওঠে কোর্টরুমের পরিবেশ।

সাক্ষ্যে সোনিয়া বলেন, আমার ছেলে ১০ পারা কোরআন মুখস্থ করেছিল। গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমার ছেলে নিয়মিত আন্দোলনে যেত। আন্দোলনে আমিও গিয়েছিলাম। কারণ, আমরা চাইছিলাম দেশে একটি পরিবর্তন আসুক।

বিজ্ঞাপন

সেদিন ৫ আগস্ট ছেলের সঙ্গে শেষ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে সোনিয়া বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমার ছেলে নাশতা করার পর আমাকে বলেÑমা, আমি আমার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে আন্দোলনে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি মেয়ে নাফিসাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য রওনা দিই। পথে পুলিশ আমাকে কোথায় যাই জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, আমার এক আত্মীয় মারা গেছেন, আমি সেখানে যাব। তখন আমাকে যেতে দেওয়া হয়।

আইডিয়াল স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছালে পুলিশ আমার রিকশা থামিয়ে দেয়। রিকশা থেকে নেমে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হেঁটে আন্দোলনে অংশ নিই। তখন দুপুর আনুমানিক ১২টা। এর এক ঘণ্টা পর মোবাইল চেক করে দেখি আমার মোবাইলে অনেকগুলো কল এসেছে। কলগুলো ছিল আমার ছোট ভাই আসিফের। কিন্তু আন্দোলনের স্লোগানের কারণে কল প্রথমে ধরতে পারিনি। একটু পর আবার আসিফ আমাকে কল করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলে। সে বলে, জুনায়েদ মাথায় ব্যথা পেয়েছে; তুমি দ্রুত বাসায় আসো।

এরপর দ্রুত মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন সোনিয়া। তিনি বলেন, বাসায় ঢোকার পর দেখি আমার ছেলে জুনায়েদকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার বাম চোখের বাম পাশে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে। তখনো অনেক রক্ত বের হচ্ছিল। তার নিথর দেহ বিছানায় পড়ে আছে। তা দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

এ কথা বলতে বলতেই আদালতে জুনায়েদের মা অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন। এরপর আর কথা বলতে পারছিলেন না।

কিছুক্ষণ পর সোনিয়া আবার কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, তার বন্ধুরা জানায়, ওইদিন আন্দোলনে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের অপর পাশে চানখাঁরপুল এলাকার ফুটপাতের ওপর জুনায়েদকে পুলিশ গুলি করে। তার বন্ধু সিয়াম ও আব্দুর রউফ তাকে মিটফোর্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, সে আগেই মারা গেছে। তারা আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে। আসরের পর আমার ছেলের লাশ স্থানীয় ধূপখোলা মাঠে জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আমার স্বামীর কাছে জেনেছি, সেখানে শাহরিয়ার খান আনাস নামে আরেক শহীদের জানাজা হয়েছে। আমার ছেলে এবং তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় ।

জুনায়েদের মা জানান, মোবাইলে দেখেছি, আন্দোলনের সময় একজন পুলিশ গুলি করার ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেখাচ্ছে এবং বলছে, স্যার গুলি করি মরে একজন, বাকিরা যায় না। বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে আমার ছেলে জুনায়েদসহ নিরপরাধ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আব্দুল্লাহ আল মামুন। আদালতে তিনি গুলিতে নিহত জুনায়েদের দুটি ভিডিও প্রদর্শন করেন। পরে সেগুলো জমা দেন। তিনি এ হত্যার জন্য তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার, এডিসি আক্তারুল ইসলাম এবং কনস্টেবল সুজন, ইমাজ ও নাসিরুলের বিচার দাবি করেন।

সোনিয়ার সঙ্গে আসা তার নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলেকে হারিয়ে শোকে ডুবে আছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ছেলের শোকে রান্না পর্যন্ত ভুলে গেছেন। এখনো তিনি প্রতিদিন ঘরে তার ছেলের ব্যবহার করা জায়নামাজ, টুপি জড়িয়ে ধরে থাকেন।

ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত বিচারিক প্যানেলে মানবতাবিরোধী মামলার এ সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত