মুসলিম নারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

মোহনা জাহ্নবী
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৩: ১১
আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৫, ১৬: ১০

আজ থেকে অনেক বছর আগেও জ্ঞানে-গুণে, চিন্তাধারায় ক্ষেত্রবিশেষে নারীরা কত এগিয়ে ছিলেন, জানলে অবাক হতে হয়। তেমনই একজন আলোকিত নারী ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ। জ্ঞানের আলোয় তিনি শুধু নিজেই আলোকিত হননি, বরং আরো অসংখ্য মানুষকে আলোকিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন আল-কারাওইন নামে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউরোপীয় সভ্যতার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ইংরেজি ভাষাভাষীদের সবচেয়ে প্রাচীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৬৩৬ সালে। ইতালির বোলোগ্না বিশ্ববিদ্যালয়, যা আরো পুরাতন, প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে। অন্যদিকে, মিসরের আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় ৯৭০ সালে। কিন্তু তারও আগে মরক্কোতে ‘আল-কারাওইন’ নামে আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ইউনেসকো ও গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী সেটি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত, যা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান।

বিজ্ঞাপন

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা একজন নারী। মরক্কোর ফেজ নামক জায়গায় ৮৫৯ সালে বিশ্বনন্দিত মুসলিম নারী ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।

fatima_al-fihri-Help-for-Reverts-Inspiring-3

ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদের জন্ম

ফাতিমা আল-ফিহরির জন্ম ৮০০ সালে, বর্তমানের তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে। তার পুরো নাম ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরিয়া আল-কুরাইশিয়া। পারিবারিক নামের ‘কুরাইশিয়া’ থেকে ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশধর। উমাইয়া শাসকদের হাতে তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরটির গোড়াপত্তন হয়েছিল। নবম শতকের শুরুর দিকে শহরটি হয়ে উঠেছিল ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সামরিক দিক থেকেও শহরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। তবুও সেখানের কিছু মানুষকে সংগ্রাম করতে হতো অভাবের সঙ্গে। ফাতিমার পরিবারটিও ছিল তেমন।

ভাগ্যের অন্বেষণে অন্য শহরে

ফাতিমার জন্মের কয়েক বছর পর তার পরিবার ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমায় ইসলামিক মাগরেবের প্রসিদ্ধ শহর মরক্কোর ফেজে, যা বর্তমানে কসমোপলিটন শহর হিসেবে পরিচিত। তখন ফেজের শাসক ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় ইদ্রিস। তিনি অন্য দেশের নাগরিকদের ফেজ নদীর তীরে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। ফেজে এসে ফাতিমার বাবা মুহাম্মদ আল-ফিহরির ভাগ্য সত্যিই বদলে যায়, সুসময় এসে ধরা দেয় তাকে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। হন প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। সন্তানদের সুশিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কোনো আপস করেননি। দুই মেয়ে ফাতিমা ও মরিয়মকে ক্ল্যাসিক্যাল আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্র বিষয়ে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন তিনি। ফাতিমাও শৈশব থেকে পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন।

নতুন জীবন এবং বিপর্যয়

একসময় ফেজ শহরেই ফাতিমার নতুন জীবন শুরু হয়, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ফেজেই এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সবকিছু সুন্দরভাবেই চলছিল। কিন্তু সেই সুদিন খুব বেশি দীর্ঘ হলো না। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই একের পর এক আঘাত পান তিনি, ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়োগ। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা, ভাই ও স্বামীকে হারান ফাতিমা। তবু তিনি মনোবল হারাননি।

last picture

মসজিদ নির্মাণের গল্প

বাবার মৃত্যুর পর দুই বোন পেয়ে যান বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি। এত সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন, ভাবতে থাকেন ফাতিমা। তত দিনে ফেজ শহরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। কেন্দ্রীয় মসজিদে তাদের জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। ফাতিমা সিদ্ধান্ত নেন, মসজিদ নির্মাণ করবেন, বিলাসিতার পেছনে অপচয় না করে ধর্ম ও মানবকল্যাণমূলক কাজেই ব্যয় করবেন সব।

যেই ভাবা সেই কাজ। দুই বোন মিলে শুরু করে দিলেন মসজিদ নির্মাণের কাজ। মরিয়ম নির্মাণ করলেন আন্দালুস মসজিদ। আর ফাতিমা ‘হাওয়ারা’ গোত্রের এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনে শুরু করলেন নিজের জন্মস্থান কাইরাওয়ানের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কারাওইন মসজিদ নির্মাণকাজ। বিশ্ববিদ্যালয়টির একসময়কার শিক্ষক ইবনে আবি জারার বর্ণনা থেকে জানা যায়, কারাওইন মসজিদের নির্মাণ শুরু হয় ২৫৪ হিজরি রমজান মাসে, অর্থাৎ ৬৫৯ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে, তখন পবিত্র রমজান মাস। নির্মাণকাজ শেষ হতে কত সময় লেগেছিলÑতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোথাও লেখা ১৮ বছর, কোথাও ১১, কোথাওবা দুই বছর সময়কালের কথা লেখা। যদি ১৩২৩ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ব্যাপক ক্ষতি না হতো, তাহলে নির্মাণকাল জানা যেত। ধারণা করা হয়, ফাতিমা সম্পর্কে সংরক্ষিত সমস্ত তথ্য ওই আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে জানা যায়, ফাতিমা নিজে উপস্থিত থেকে নির্মাণকাজের তদারকি করেছেন পুরোটা সময়। এমনকি নির্মাণ শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি রোজা রেখেছিলেন। নির্মাণ শেষে মসজিদের ভেতর ঢুকে নামাজ আদায় করেছেন, শুকরিয়া জানিয়েছেন আল্লাহর কাছে।

যেভাবে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়

মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর মসজিদের বর্ধিতাংশে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন ফাতিমা। ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ নানা বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু হয় সেখানে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ডিগ্রি প্রদানের প্রচলনও চালু হয়। দশম শতাব্দী থেকে মাদরাসাটির খ্যাতি আফ্রিকা ছাড়িয়ে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আশপাশের অনেক দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে থাকেন এখানে এবং মাদরাসাটি আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। আর এই মসজিদ এবং মাদরাসাটিই শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর চারপাশ ঘিরে বাজার, স্কুল, আবাসন ব্যবস্থা, হামাম বিভিন্ন কিছু গড়ে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সমাগমও বাড়তে থাকল।

পৃষ্ঠপোষকতা

এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল ক্ষমতাধর সুলতানদের কাছ থেকেও। বিশ্ববিদ্যালয়টি মরক্কোর শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠছিল এবং শুধু সুলতানই শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারতেন।

Cap

বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য শিক্ষার্থীরা

আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামিক বিশ্ব ও ইউরোপের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু মুসলমান নন, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি, খ্রিষ্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপিয়ানদের গবেষণার কাজে সহায়তা করেছিল মুহাম্মদ আল ইদ্রিসীর মানচিত্র, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা অনেক পণ্ডিত তাদের কাজের মাধ্যমে বিশ্বকে আলোকিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইবনে রাশেদ আল-সাবতি, মুহাম্মদ ইবনে আলহাজ আল আবদারি আল-ফাসি, আবু ইমরান আল-ফাসি, তাত্ত্বিক মালিকী ও বিখ্যাত পর্যটক ও লেখক রাব্বি মুসিবিন মায়মন। পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টারও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এখান থেকেই আরবি সংখ্যাপদ্ধতি শিখে তিনি ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফাতিমা নিজেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনুকরণীয়

যেহেতু এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউরোপ কিংবা বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে নির্মাণ করা হয়েছিল, তাই এটির পাঠদান পদ্ধতি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সমাবর্তনের পদ্ধতিও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণ করেছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারদের পাগড়ি ও গাউন পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হতো। আজকের আধুনিক বিশ্বে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আমরা যেই গাউন ও হ্যাট পরতে দেখি, তা মূলত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণেই আজকের রূপ পেয়েছে।

fatima_al-fihri-Help-for-Reverts-Inspiring-5

প্রাচীন লাইব্রেরি

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে মনে করা হয়। অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ পাণ্ডুলিপি নষ্ট হওয়ার পরও চার হাজারের বেশি প্রাচীন ও দুর্লভ পাণ্ডুলিপি রয়েছে এখানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পাণ্ডুলিপি হলো, হরিণের চামড়ার ওপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর লেখা মুয়াত্তার পাণ্ডুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, হাদিসের সংকলন, ইবনে ইসহাকের লেখা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী, ইবনে খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার ও আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপি।

সংস্কার

এ মসজিদটির মূল গঠন ছিল ৩০ মিটার লম্বা। সঙ্গে একটা গোল চত্বর এবং চারটি তির্যক স্তম্ভবেষ্টিত ঘোরানো গলি। ৯৫৬ সালে প্রথমবার মসজিদটি সংস্কার করেন করোডোবার খলিফা তৃতীয় আব্দুর আর রাহমান। নামাজ কক্ষটি তখন আরো বাড়ানো হয় এবং মিনারগুলোকে আবার স্থানান্তরিত করা হয়। মসজিদে একটি আলাদা কক্ষ ছিল, যার নাম ‘দার-আল-মুয়াকিত’। সেখানে নামাজের সময় ঠিক করা হতো। সে সময় ফেজের অন্য মসজিদগুলো আজানের ডাক দিত আল-কারাওইন মসজিদে ডাক শোনার পর।

পরে মসজিদের উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন ১১৩৫ সালে, সুলতান আলী ইবনে ইউসুফ। তিনি মসজিদের মধ্যকার বারান্দার সংখ্যা ১৮ থেকে ২১-এ করার আদেশ দেন। মসজিদের কাঠামো ৩,০০০ বর্গমিটারে উন্নীত করেন। এখন পর্যন্ত এভাবেই মসজিদটি অনেকবার সংস্থাপন, পুনঃসংস্থাপনের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিক মরক্কোর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। হাজার বছরের বিবর্তন সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যে এখনো ফাতিমার নির্মিত সেই ভবনগুলোর ছাপ রয়ে গেছে।

fatima_al-fihri-Help-for-Reverts-Inspiring-2

শেষ কথা

ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের নিজ দায়িত্বে পড়াতেন বলে ‘উম্মে আল বানিয়ান’ বা ‘সন্তানদের মা’ নামেও পরিচিত ছিলেন ফেজে। ৮৮০ সালে পরলোকগমন করেন এই মহীয়সী নারী। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইসলামি মূল্যবোধ এবং পাঠদানের ইসলামি পদ্ধতির প্রতি এখনো বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি নানা বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রি প্রদানকারী প্রাচীনতম একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যা টানা ১২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত