একাডেমিক সংকট ও প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন।
তবে সেই নিয়োগে সুপারিশ করার পরও নিজের পক্ষের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ তুলে এসব নিয়োগ বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন কুমিল্লা-০৬ আসনের বিএনপির মনোনীত সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী। তবে কী কী অভিযোগ করেছিলেন, তা তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে তার এই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এ. এস. এম কাসেমের স্বাক্ষরিত চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। সেই চিঠির একটি কপি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিবর্তন হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পর নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ১৭ জন শিক্ষক এবং একই মাসে ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই নিয়োগে নিজের পক্ষের লোক নিয়োগ দিতে শিক্ষক-ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে প্রশাসনকে চাপ দিতে থাকেন মনিরুল হক চৌধুরী। তবে সেই চাপ উপেক্ষা করে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানায় প্রশাসন।
যিনি চিঠির অভিযোগের বিষয়ে জানেন না, তার অভিযোগ আমলে কেন নেওয়া হয়েছে তা জানতে এ.এস. এম কাসেমের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয় নি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কুমিল্লার কুমিল্লা ০৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠিতে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করেন মনিরুল হক চৌধুরী। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্য ফাঁস সংক্রান্ত মামলায় ১১ নম্বর আসামি হওয়ার পরও উপাচার্যের দায়িত্ব পালন, ছয় মাসে বেতন-ভাতার বাইরে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ সম্মানী হিসাবে প্রায় ৬ লাখ ও ৪ লাখ টাকা উত্তোলন, উপাচার্য–কোষাধ্যক্ষের যোগসাজশে প্রায় ১০ কোটি টাকার টেন্ডার দুর্নীতি, সাম্প্রতিক শিক্ষক নিয়োগে কোটি টাকার ‘নিয়োগ বাণিজ্য’, ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন নিয়োগ বাণিজ্যের প্রস্তুতি, রেজিস্ট্রারকে ‘অযৌক্তিকভাবে’ বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভাগীয় প্রধানকে রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া, বেগম খালেদা জিয়া উন্মোচিত উদ্বোধনী ফলক ও বিএনপি এমপিদের নাম সংবলিত ফলক পুনঃস্থাপনে উদাসীনতা, প্রকল্প সংক্রান্ত ভূমি বাণিজ্য, পাহাড় কাটা ও পরিবেশ ধ্বংসে তদন্ত না করা, জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তথাকথিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের পদধারীদের ছাত্র উপদেষ্টা, প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর ও সহকারী প্রক্টর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া।
ফলে এই সুবিধাবাদী ও মতলবি প্রশাসন কর্তৃক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ কোনোভাবেই স্বচ্ছ হতে পারে না। এমতাবস্থায় সকল নিয়োগ কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা আবশ্যক।
“তিনি আরও দাবি করেন, ২০০৬–০৭ শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সব প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম তার অর্থায়নেই সম্পন্ন হয়েছিল। এতকিছুর পরও নিজের স্বপ্নের এই ক্যাম্পাসটি একবার দেখার জন্যও তাকে কখনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ফলে উল্লিখিত অভিযোগগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি তিনি।”
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানায়, নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন এবং একাডেমিক মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়েছিল। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অন্যদিকে কুবির বিভিন্ন বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। শিক্ষকের অভাবে ক্লাস না হওয়ায় গত ৩ আগস্ট সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছিল।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা ভবিষ্যতের জন্য ‘অশনি সংকেত’ বলে মনে করছেন তারা।
অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা ও কুমিল্লা ০৬ আসনের মনোনীত (সাবেক) সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরীর সাথে বারবার মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে রাজি নন। একপর্যায়ে বলেন যে, “কী কী অভিযোগ দিয়েছি সেগুলো তো এখন মনে নেই। দেখে বলতে হবে। আমাকে একজন চিঠি দিয়েছিল আমি তা সচিবের কাছে পাঠিয়েছি। কেউ অভিযোগ দিলে আমি সচিবের কাছে পাঠাই। এটা আমার অভ্যাস।”
“আপনাকে কে অভিযোগ দিয়েছে?” জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনাকে আমি বলতে বাধ্য নই।” এই বলে তিনি প্রতিবেদকের ফোন কেটে দেন।
কিন্তু অভিযোগপত্রে দেখা যায়, তিনি নিজের নামেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর উক্ত অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী বলেন, “আমি এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তির পর থেকেই একটা গোষ্ঠী আমার মানহানির উদ্দেশ্যে বারবার বিভিন্ন মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ করে আসছে। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলি, আমার বিরুদ্ধে তাদের করা সকল অভিযোগ নিয়েই নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। তাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে আমি ও আমার প্রশাসন প্রস্তুত আছি।”
তিনি আরো বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোভাবে পরিচালনা করতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমি আসার পরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সবাই নিজেদের যোগ্যতাবলেই নিয়োগ পেয়েছেন। সামনেও যারা নিয়োগ পাবেন, তারাও মেধা এবং যোগ্যতাবলেই নিয়োগ পাবেন।”
তিনি আরো বলেন, “প্রতিবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরপরই একটা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আমাকে চাপ দেয়া হয় যে তাদের পরামর্শের আলোকে যেন নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা হয়। কিন্তু সুষ্ঠু এবং যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে নিয়োগ দিতে হলে আমার পক্ষে কারো কথা রাখা সম্ভব না। তাদের কথা রাখা হয় না বলেই আমার নামে এমন ভিত্তিহীন সব অভিযোগ দেয়া হয়েছে।”
এছাড়াও ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা ভর্তি পরীক্ষার টাকা। ভর্তি কমিটির বরাদ্দ অনুসারে প্রশাসনের সবাই টাকা পেয়েছে। আমি ৫ লাখ, উপ-উপাচার্য ৪ লাখ ৫০ হাজার, কোষাধ্যক্ষ ৪ লাখ টাকা। আর মিটিংসহ সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকা।”

