ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা

ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার আলোকবর্তিকা

শাহ বিলিয়া জুলফিকার
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৪: ১২

শিক্ষা, ঐতিহ্য ও মানবিক মূল্যবোধের এক অপূর্ব মেলবন্ধনের নাম ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা। সময়ের প্রবাহে নানা চ্যালেঞ্জ আর পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েও এই প্রতিষ্ঠান অবিচল থেকেছে তার আদর্শিক যাত্রায়। এখানে প্রতিটি দেয়াল কথা বলে অতীতের, প্রতিটি করিডোরে ধরা দেয় অধ্যবসায়ের গল্প। মাদরাসাটির প্রতিটি প্রাচীরে, প্রতিটি ক্লাসরুমে, বইয়ের পাতায় জমে আছে এক অনন্ত সাধনা, এক নিরন্তর অভিযাত্রা। ধর্মীয় শিক্ষা আর আধুনিক জ্ঞানের সেতুবন্ধে এগিয়ে চলা এই প্রতিষ্ঠানটি আজ কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্র নয়, বরং একটি আদর্শ, একটি আলোকবর্তিকা। ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়েই আজকের আয়োজন।

বিজ্ঞাপন
Madrasha-1

প্রতিষ্ঠার গল্প

ঝালকাঠি জেলার বাসন্ডা গ্রামে অবস্থিত এনএস কামিল মাদরাসা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দীর্ঘ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। হজরত মাওলানা মুহাম্মদ আযীজুর রহমান নেছারাবাদীর (কায়েদ ছাহেব হুজুর রহ.) হাতে ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসার সূচনা হয় ফোরকানিয়া স্তরের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার পরিধি ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ১৯৬১ সালে দাখিল স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় এবং ১৯৮৬ সালে মাদরাসাটি কামিল স্তরে উন্নীত হয়, যা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।

১৯৯৪ সালে সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ খলীলুর রহমান নেছারাবাদী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মাদরাসার বহুমুখী উন্নয়নযাত্রা শুরু হয়। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে দাখিল ও আলিম স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয় এবং ফাজিল বিএ, ফাজিল অনার্স ও কামিল মাস্টার্স কোর্স চালুর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। পাশাপাশি কামিল স্তরে তাফসির, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য (আদব) বিভাগও চালু করা হয়।

একাডেমিক অগ্রগতির পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চলতে থাকে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে ত্যাগী, মুত্তাকী, মুখলেছ, সৎ ও দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী, যাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা শিক্ষার গুণগত মানকে করেছে অনন্য। দলীয় রাজনীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও মনোগ্রাহী পরিবেশে পরিচালিত হওয়ায় আজ ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অর্জন করেছে।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসার প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিগত, মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান, শিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। মাদরাসাটির পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রমগুলো এই উদ্দেশ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ বিশ্বাস, আধুনিক জ্ঞান ও নৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে উন্নত চরিত্র গঠন করা এখানে প্রধান উদ্দেশ্য। ফলস্বরূপ জাতির উন্নতির জন্য তারা দক্ষ, সৎ ও পরিশ্রমী জনশক্তি হিসেবে অবদান রাখবে।

Madrasha-3

মাদরাসাটির বৈশিষ্ট্য

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা শিক্ষা, আদর্শ ও নীতিতে এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এখানে আল-ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ অর্থাৎ মতানৈক্যসহ ঐক্যের নীতিতে শিক্ষাদান করা হয়। ফলে কলেমায় বিশ্বাসী যেকোনো ছাত্র এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হানাফি মাজহাব, সুন্নিয়া তরিকা ও ছেলসেলা অনুসরণে অটুট, যা শিক্ষাঙ্গনের আদর্শিক দৃঢ়তা প্রকাশ করে।

এখানে শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ রাখা হয় না; বরং ইসলামি জীবন গঠনের জন্য বাস্তব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনটি দলীয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, ফলে শিক্ষার্থীরা একটি নির্মল ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নিজেদের বিকশিত করতে পারে। সুন্নত তরিকার কঠোর অনুসরণে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণেও ইসলামের সৌন্দর্য প্রতিফলিত করার জন্য নিবিড় প্রচেষ্টা চালায়।

পাঠদানের ক্ষেত্রে ক্যাডেট, কিন্ডারগার্টেন, ফোরকানিয়া ও নুরানি শিক্ষা পদ্ধতির সমন্বয় করা হয়েছে, যাতে ছাত্ররা শুরু থেকেই একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর শিক্ষালাভ করতে পারে। এখানে সেমিস্টারভিত্তিক পাঠদান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যাতে নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি নিরীক্ষণ করা সম্ভব হয়। বছরের শুরুতেই পাঠ্যবিষয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে বিশেষ ক্লাসের মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশে রয়েছে সাপ্তাহিক জলসা, সাধারণ জ্ঞান, বিতর্ক, রচনা প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম। প্রতিটি শ্রেণির জন্য আলাদা ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য ও সহপাঠ্য কার্যক্রম সম্পর্কে শুরু থেকেই স্পষ্ট ধারণা লাভ করে। প্রতিবছর অভিভাবক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যাতে অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি নিয়ে সরাসরি আলোচনা করা সম্ভব হয়।

আধুনিক ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত হয় আরবি ও ইংরেজি ভাষা কোর্স। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানার্জনের জন্য রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। হাফেজ ছাত্রদের উচ্চতর পড়াশোনার জন্য আলাদা তাহিলি মাদরাসা চালু রয়েছে এবং স্কুল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি স্বতন্ত্র স্কুল বিভাগ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ রাখা হয়েছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে নিজ উদ্যোগে আত্মনির্ভরশীল জীবন গড়তে সক্ষম হয়।

শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন মাত্রা

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা প্রথাগত ইসলামি শিক্ষার ধারার পাশাপাশি আধুনিক পাঠক্রমের সমন্বয় ঘটিয়েছে। এখানে হাদিস, ফিকহ, তাফসিরসহ অন্যান্য ইসলামি শাস্ত্রের পাঠদান ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শিক্ষার ওপরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাদরাসাটিতে রয়েছে আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের পাঠ্যক্রম। এখানে পাঠদান পদ্ধতি অত্যন্ত আধুনিক ও সময়োপযোগী। শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাদান চালু করা হচ্ছে। নিয়মিত ক্লাস টেস্ট, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনন বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

সুসজ্জিত ও গোছানো ক্যাম্পাস

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসার ক্যাম্পাসটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, যা বাসন্ডা নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর পাড়ে অবস্থিত পাকা ঘাটলা, সাজানো ফুলের বাগান এবং সুশৃঙ্খল পাকা রাস্তা মাদরাসাটিকে একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশে পরিণত করেছে। এ পরিবেশে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও শারীরিক সুস্থতায় দৃষ্টি দিতে সক্ষম হয়।

দৃষ্টিনন্দন গেট

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসার প্রধান ফটকটি এখন প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের আদলে নির্মিত এই স্থাপত্যশৈলী শুধু একটি প্রবেশদ্বার নয়, বরং একটি নান্দনিক শিল্পকর্ম। গেটটির প্রতিটি ধাপে ফুটে উঠেছে স্থাপত্যের সৌন্দর্য, ঐতিহ্য আর আধুনিকতার চমৎকার সমন্বয়। গেটের নকশায় বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়েছে। এর উচ্চতা, কারুকাজ আর রঙের সমন্বয় মাদরাসার গৌরবময় ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেটের পাশেই তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এক ফুলের বাগিচা। বাহারি রঙের ফুলে ফুলে যেন প্রতিদিন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় গোটা পরিবেশ। এই বাগান শুধু সৌন্দর্য বাড়ায়নি, বরং শিক্ষার্থীদের মনন ও মেধা বিকাশেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আবাসন সুবিধা

নুরানি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। স্কুল থেকে আগত ছাত্রদের জন্য রয়েছে পৃথক স্কুল বিভাগ ছাত্রাবাস। হাফেজ ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে তাহিলি ছাত্রাবাস। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য চতুর্থ শ্রেণি থেকে কামিল পর্যন্ত সাধারণ ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি মফিজিয়া ইয়াতিমখানায় এতিম ছাত্রদের জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে। দরসে নেজামি বা কওমি ধারার শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে আলাদা ছাত্রাবাস। ছেলে ও মেয়েদের জন্য রয়েছে পৃথক ক্যাম্পাস এবং পৃথক ছাত্রাবাস। ছেলেদের জন্য রয়েছে চারটি ছাত্রাবাস এবং মেয়েদের জন্য দুটি। প্রতিটি ছাত্রাবাসে শ্রেণিভেদে একজন করে আবাসিক অভিভাবক (জামাত নাজেম) দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সহযোগিতায় ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রতিটি রুমের জন্য একজন করে মোহাফেজ এবং সালার মনোনীত থাকে, যারা শৃঙ্খলা ও শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়তা করে।

কম্পিউটার ও সায়েন্স ল্যাব

মাদরাসাটির একটি আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা উন্নত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। তা ছাড়া একটি সায়েন্স ল্যাব রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রয়োগ ও গবেষণা নিয়ে কাজ করতে পারে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ ও অনুসন্ধানে এই ল্যাবটি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করে।

বৃহৎ লাইব্রেরি ও রিডিং রুম

মাদরাসাটির একটি বৃহৎ লাইব্রেরি রয়েছে, যা কোরআন, হাদিস, ফিকহসহ ইসলামি শিক্ষার বিভিন্ন গ্রন্থের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান ও বিজ্ঞান-সম্পর্কিত বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ ধারণ করে। এই লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চায় অনুপ্রাণিত করে এবং তাদের শিক্ষার গভীরতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। লাইব্রেরির পাশাপাশি একটি রিডিং রুমও রয়েছে। রিডিং রুমটি সার্বক্ষণিকভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এটি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য একটি নীরব পরিবেশ প্রদান করে, যেখানে তারা অবসর সময়ে বিভিন্ন বই পড়ে নিজের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি আরো সমৃদ্ধ করতে পারে।

শিক্ষাস্তর ও বিভাগ

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসায় ধারাবাহিক ও সুচিন্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে রয়েছে ফাজিল ও কামিল (হাদিস, তাফসির, ফিকাহ ও আদব) বিভাগ, পাশাপাশি রয়েছে ফাজিল অনার্স কোর্স (আল কোরআন, আল হাদিস, ইসলামের ইতিহাস) ও কলেজ বিভাগ। শিক্ষার্থীরা আবাসিক ও অনাবাসিক দুভাবেই অধ্যয়ন করতে পারে। মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও বিশেষ ব্যবস্থায় সাফল্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে আলিম (সাধারণ ও বিজ্ঞান) শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে আবাসিক ও স্থানীয় অনাবাসিক ছাত্রদের জন্য পৃথক আয়োজন রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে দাখিল (সাধারণ ও বিজ্ঞান) শিক্ষা প্রদান করা হয়। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অনাবাসিক শাখা এবং স্কুল বিভাগের ছাত্রদের জন্যও মাদরাসায় শিক্ষালাভের সুযোগ উন্মুক্ত।

প্রাথমিক পর্যায়ে ইবতেদায়ি বিভাগের পাশাপাশি রয়েছে নুরানি ও ফোরকানিয়া শিক্ষা। আবাসিক ও স্থানীয় অনাবাসিক ছাত্রদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। হাফেজ শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশেষ তাহিলি কোর্স, যেখানে মাত্র পাঁচ বছরে দাওরার মতো উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

মাদরাসায় দরসে নেজামি শিক্ষার মাধ্যমে আবাসিক কেতাবখানা, মাদানি নেসাব ও ইফতা কোর্সের সুচারু ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। পাশাপাশি শিশু ও কিশোরদের দ্রুত সময়ে হাফেজ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ক, খ, গ শাখায় বিভক্ত হেফজুল কোরআন বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে।

পরীক্ষা পদ্ধতি, ক্লাসটেস্ট ও ফলাফল

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসায় ইবতেদায়ি চতুর্থ শ্রেণি থেকে কামিল এমএ, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে তিনটি সেমিস্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ক্লাস চলাকালে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষক নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী লিখিত ক্লাসটেস্ট গ্রহণ করেন। তেলাওয়াত, ইসলামি জীবন, আমলি প্রাকটিক্যাল, প্রতিভা মূল্যায়ন, তাহরির ও কম্পিউটার প্রাকটিক্যাল বিষয়ে মৌখিক ক্লাসটেস্ট নেওয়া হয়।

চতুর্থ শ্রেণি থেকে আলিম পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় সেমিস্টারে তিনটি করে এবং তৃতীয় সেমিস্টারে অন্তত আটটি ক্লাসটেস্ট গ্রহণ করা হয়। অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে প্রতি বর্ষে তিনটি করে ইনকোর্স পরীক্ষা এবং কামিল (এমএ) পর্যায়ে প্রতি সেমিস্টারে দুটি করে ইনকোর্স পরীক্ষা হয়। ক্লাসটেস্ট ও সেমিস্টার পরীক্ষার সম্মিলিত ফলাফলের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হয়। তবে তেলাওয়াত, ইসলামি জীবন ও আমলি প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমলি প্র্যাকটিক্যালের জন্য নির্ধারিত ফরম প্রতিদিন পূরণ করতে হয় এবং নির্ধারিত নিয়মে পিতা/অভিভাবক বা নাজেমের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটি বিষয়ে ২০ নম্বরের ক্লাসটেস্ট এবং ৮০ নম্বরের সেমিস্টার পরীক্ষা নেওয়া হয়। অনার্স পর্যায়ে ১৫ নম্বর ইনকোর্স, ৫ নম্বর উপস্থিতি ও ৮০ নম্বর ফাইনাল পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী বিষয়-শিক্ষকরা ক্লাসটেস্ট গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ করেন।

Madrasha-2

কৃতিত্বে উজ্জ্বল

মাদরাসাটি শিক্ষাক্ষেত্রে বরাবরই অসাধারণ সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে। প্রতি বছর আলিম, ফাজিল ও কামিল পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। বিশেষ করে কামিল স্তরের জাতীয় পর্যায়ের ফলাফলে মাদরাসার নাম উজ্জ্বলভাবে উচ্চারিত হয়। গত আলিম পরীক্ষার ফলাফলে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে শীর্ষস্থানে রয়েছে ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা। মাদরাসায় পাসের হার ৯৯ দশমিক ২৩। এ বছর মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ২৫৯ জন।

২৫৭ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১০২ জন, জিপিএ-৪ পেয়েছেন ১৪৫ জন এবং বাকি সবাই বিভিন্ন গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

নিপুণ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকবৃন্দ

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসার সাফল্যের অন্যতম মূল ভিত্তি এর দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকরা। বর্তমানে মাদরাসাটিতে সাধারণ বিভাগ, তাহিলি বিভাগ, কিতাব বিভাগ, অনাবাসিক শাখা ও বালিকা শাখা এবং নুরানি বিভাগসহ প্রায় দের শতাধিক অভিজ্ঞ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন, যারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখানে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, নৈতিক উন্নয়ন ও ক্যারিয়ার গঠনে শিক্ষকরা সদা পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় থাকেন।

সহশিক্ষা কার্যক্রম

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা শুধু পাঠ্যবইয়ের জগতে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে সহশিক্ষা কার্যক্রমেরও বিশাল বিস্তার রয়েছে। প্রতি বছর বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাসব্যাপী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও নানা উৎসবের আয়োজন করা হয়। ‘মুছলিহীন শিল্পী’ গোষ্ঠী নামে মাদরাসার নিজস্ব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে, যারা নিয়মিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও নাত পরিবেশনার আয়োজন করে। তা ছাড়া ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব ও ডিবেটিং ক্লাব রয়েছে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় জমিয়তে তোলাবায়ে মুছলিহিন (সংক্ষেপে-ছাত্র জমিয়ত) দ্বারা।

সমস্যা ও সম্ভাবনার কথকতা

প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়নরত এইচ এম তাওহীদ জানান, ‘যদিও ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা অনেক দিক থেকে এগিয়ে, তবে কিছু সমস্যা এখনো রয়েছে। মূল ভবনের আধুনিকায়ন প্রয়োজন, লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা আরো বাড়ানো উচিত এবং একটি নির্দিষ্ট গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।’ এ ছাড়া আরেক সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নরত মো. হাসানাত জানান, ‘এই মাদরাসার সম্ভাবনা অপার। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা বাড়লে ভবিষ্যতে এনএস কামিল মাদরাসা কেবল ঝালকাঠির গর্ব নয়, সারাদেশের একটি মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করাও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত