শতাব্দী ধরে স্বমহিমায় দারুল উলূম হাটহাজারী

মুহাম্মাদ ইশতিয়াক সিদ্দিকী
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১২

দেশের প্রাচীন ও বৃহৎ কওমি মাদরাসাটি ‘হাটহাজারী মাদরাসা’ নামে সর্বাধিক পরিচিত হলেও এর অফিশিয়াল নাম ‘আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসা বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে বাঁশের তৈরি বেড়ার ঘর থেকে দৃষ্টিনন্দন বহু ইমারতে সাজানো-গোছানো বাগানটি আজকের ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা-দীক্ষাদান ও প্রচার-প্রসারের সূতিকাগার। বিস্তারিত লিখেছেন মুহাম্মাদ ইশতিয়াক সিদ্দিকী

বিজ্ঞাপন

যেভাবে প্রতিষ্ঠা

ভারতের দেওবন্দের শীর্ষ বুজুর্গ হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর নির্দেশক্রমে দারুল উলূম হাটহাজারীর বরকতময় যাত্রা শুরু হয়েছিল আল্লাহভীরু মুখলিস চার মহামনীষীর হাত ধরে। তারা হলেন-

আল্লামা হাবিবুল্লাহ কুরাইশি (রহ.), আল্লামা আব্দুল ওয়াহেদ (রহ.), সুফি আজিজুর রহমান (রহ.) ও আল্লামা আব্দুল হামেদ (রহ.)।

তাদের হাত ধরে শুরু হওয়া ছোট্ট মাদরাসাটি নাম জানা-অজানা অগণিত ঈমানদার মাদরাসাপ্রেমীদের দানকৃত জমি, অর্থ, সময়, পরিশ্রম, মেধা, ঘাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাস-বছর পেরিয়ে শতবর্ষ পার করে আজকের ‘উম্মুল মাদারিস’ (মাদরাসাগুলোর মা/ মূল)।

শুরুরদিকে হাটহাজারী পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে পাঠদান চললেও বর্তমান স্থানে মাদরাসাটি স্থায়ী কার্যক্রম শুরু করে। পর্যায়ক্রমে আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এটি ৪.৪৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।

শিক্ষাব্যবস্থা: বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দের অনুসৃত ‘উসূলে হাশতেগানা’ (অষ্ট মূলনীতি) মেনে এখানে ‘দরসে নেজামি’ শিক্ষাক্রম শতবর্ষ ধরে অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

শিক্ষাস্তর ও পাঠ্যক্রম

১. হিফজ বিভাগ

২. প্রাথমিক স্তর

উর্দু, ফারসি, নাহু, সরফ, আকাইদ, সিরাত ও সাধারণ পাঠ।

৩. মাধ্যমিক স্তর

উচ্চতর আরবি ব্যাকরণ, মাধ্যমিক ফিকহ, উসূলে ফিকহ, আরবি সাহিত্য ও তর্কশাস্ত্র।

৪. উচ্চমাধ্যমিক স্তর

উচ্চতর উসূলে ফিকহ, তর্কশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, অর্থনীতি ও আরবি সাহিত্য।

৫. স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তর

তাফসির, প্রাচীন মতবাদ ও উসুলুল হাদিস এবং দশটি বিশ্ববিখ্যাত হাদিস গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ পাঠদানের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করা হয়।

উচ্চতর গবেষণা বিভাগগুলো

মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর এক ও দুই বছর মেয়াদি গবেষণার সুযোগ রয়েছে :

১. উচ্চতর কোরআন গবেষণা (১ বছর)

২. উচ্চতর হাদিস গবেষণা (২ বছর)

৩. উচ্চতর ইফতা বিভাগ (২ বছর)

৪. উচ্চতর কিরাত বিভাগ (১ বছর)

৫. উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ (১ বছর)

৬. উচ্চতর দাওয়াহ ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগ (১ বছর)

৭. উচ্চতর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ (১ বছর)

ছাত্র-শিক্ষক

শিক্ষা পরিচালনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১১০ জন দেশবরেণ্য অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী ও কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে আট সহস্রাধিক ছাত্র পড়াশোনা করছে। চলতি শিক্ষাবর্ষে শুধু দাওরায়ে হাদিসে (মাস্টার্স) ২ হাজার ৯৭৬ জন ছাত্র অধ্যয়ন করছে। তা ছাড়া প্রায় ৪ হাজার ৭০০ জন গরিব মেধাবী ছাত্রকে বিনামূল্যে ও অর্ধমূল্যে বোর্ডিং থেকে দুবেলা ফ্রি খাবার দেওয়া হয়।

মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন যারা : শতবর্ষের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন মেয়াদে দারুল উলূম হাটহাজারীর দায়িত্ব পালন করেছেন মহাপরিচালকরা-

আল্লামা হাবিবুল্লাহ কুরাইশি (রহ.) (৪১ বছর), আল্লামা আব্দুল ওয়াহাব (রহ.) (৪০ বছর), আল্লামা হামেদ (রহ.) (৫ বছর), আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) (৩৩ বছর), মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (রহ.) (দায়িত্ব পাওয়ার দিনই মৃত্যু), আল্লামা ইয়াহিয়া আলমপুরী (রহ.) (২ বছর), আল্লামা খলিল আহমদ কাসেমী (২০২৩ থেকে বর্তমান)।

এশিয়ার বৃহত্তম দারুল হাদিসের উজ্জ্বল অধ্যায়

বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে হাটহাজারী মাদরাসা এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। ‘উম্মুল মাদারিস’ (মাদরাসাগুলোর মূল) নামে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানটি কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। হাটহাজারী মাদরাসার দারুল হাদিস শ্রেণিকক্ষটি এশিয়ার বৃহত্তম বলে ধারণা করা হয়। একসঙ্গে প্রায় তিন হাজার ছাত্র এই কক্ষে ক্লাস করতে পারে। শিক্ষার্থীদের কাছে এটি শুধু একটি শ্রেণিকক্ষ নয়, বরং একটি স্বপ্নের স্থান। প্রতিবছর এই শ্রেণি থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার শিক্ষার্থী ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

হাটহাজারী মাদরাসার ছয়তলার আধুনিক শিক্ষাভবনটি অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। দোতলা পুরোটাই দারুল হাদিস শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নিচতলায় রয়েছে শিক্ষা পরিচালনা বিভাগ এবং হিসাব বিভাগ। পঞ্চমতলা পর্যন্ত রয়েছে আরো সাতটি শ্রেণিকক্ষ এবং একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। ভবনের ছাদটি হেলিপ্যাড হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

জনসাধারণের ধর্মীয় সমাধানের আস্থার নাম ফতোয়া বিভাগ

হাটহাজারী মাদরাসার ফতোয়া ও ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ দেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ও সর্বজনবিদিত একটি কেন্দ্র। ১৯৪৫ সালে মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ (রহ.) হাতে ধরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ বিভাগ দেশ-বিদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় সমস্যার দলিলভিত্তিক সমাধান দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ সরকারও হাটহাজারী মাদরাসার শরিয়তসম্মত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের আইন ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।

বর্তমানে অনলাইন, অফলাইন, লিখিত এবং মৌখিক—বিভিন্ন মাধ্যমে ফতোয়া গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের ধর্মীয় সমস্যার সমাধান পেতে পারেন।

দুই বছর মেয়াদি ইফতা কোর্সের গবেষকরা প্রশ্নের দলিলভিত্তিক উত্তর প্রস্তুত করেন এবং তা তিনজন বিজ্ঞ মুফতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে সত্যায়ন করা হয়। যাচাই শেষে হাটহাজারী মাদরাসার ইফতা বিভাগ থেকে নিজস্ব প্যাডে সিল-স্বাক্ষরসহ ফতোয়াগুলো দেওয়া হয়।

জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ফতোয়া দেওয়া হয়েছে এবং নির্বাচিত ফতোয়াগুলো বিষয়ভিত্তিক দুটি ভাষায় প্রকাশিতও হয়েছে :

এক. উর্দু ভাষায় : ফতোয়ায়ে দারুল উলূম হাটহাজারী (২ খণ্ড)।

দুই. বাংলা ভাষায় : দরসুল ফিকহ (২ খণ্ড)।

ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির সমন্বয়

হাটহাজারী মাদরাসা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিস্তর অগ্রগতি অর্জন করেছে। তার প্রশাসনিক কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রায় এক দশক ধরে মাদরাসার একটি অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ সক্রিয় রয়েছে, যা এখন মাদরাসার যেকোনো সংবাদ ও তথ্যের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

মাদরাসার শিক্ষা পরিচালনা বিভাগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু উদ্ভাবনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা

ছাত্রদের ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চেহারা শনাক্তকরণ মেশিন (ফেস আইডেন্টিফিকেশন) ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে ছাত্রদের ক্লাসে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে।

সার্টিফিকেট ডিজিটালাইজেশন

মাদরাসার অধ্যয়ন সমাপ্তকারী ছাত্রদের সার্টিফিকেট সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটাল করা হয়েছে। মাত্র ১০ মিনিটের কম সময়ে সার্টিফিকেট প্রদান সম্ভব হচ্ছে।

অনলাইন ডেটাবেস

ছাত্রদের তথ্য অনলাইনে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা হয়। ছাত্রদের ফি অনলাইনে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দাতা ব্যক্তিদের জন্য অনলাইনে ডোনেশন প্রদানের সুযোগও রাখা হয়েছে।

ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট

মাদরাসার নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যা তথ্যপ্রাপ্তি ও যোগাযোগ সহজতর করেছে।

সফটওয়্যারভিত্তিক অফিস কার্যক্রম

অফিসের সব রিপোর্ট এবং কার্যক্রম সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

পুরোনো হস্তলিপির পরিবর্তে কম্পিউটার টাইপকৃত প্রিন্ট রিপোর্টের প্রচলন করা হয়েছে।

এসবের পাশাপাশি মাদরাসার উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগেও আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে। প্রজেক্টরের মাধ্যমে দুর্লভ কিতাব, ডকুমেন্টারি এবং গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স নিয়মিত প্রদর্শন করা হয়।

দাওয়াতে তাবলিগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী সমাদৃত দাওয়াতে তাবলিগের কার্যক্রমে হাটহাজারী মাদরাসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। হাটহাজারী মাদরাসায় তাবলিগ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সহযোগী মহাপরিচালক মুফতি জসীমউদ্দিন। তার দিকনির্দেশনায় মাদরাসায় তাবলিগের পাঁচটি মূল কাজ নিয়মিত পরিচালিত হয়। ছাত্ররা তাবলিগের কাজে উল্লেখযোগ্যভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রতি সপ্তাহে হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে একদিনের জামাত (খুরুজ) পাঠানো হয়। বিশেষ ছুটির সময় তিন দিন, সাত দিন, এক চিল্লা ও সালের জন্য ছাত্ররা বের হয়। রমজান মাসের দীর্ঘ ছুটি ও বিশ্ব ইজতেমায় হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

দেশের বৃহৎ নুরানি শিক্ষাব্যবস্থার তত্ত্বাবধান

বাংলাদেশে শিশুদের জন্য জনপ্রিয় শিক্ষাব্যবস্থা হলো নুরানি শিক্ষাব্যবস্থা। এই পদ্ধতি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলা, গণিত, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান বিষয়ে আধুনিক পাঠদানের মাধ্যমে এটি শিশুদের সামগ্রিক দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ইসলামি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানের এই সমন্বিত পাঠদান পদ্ধতি অভিভাবকদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।

১৯৯৫ সালে হাটহাজারীর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন আলেম প্রয়াত আল্লামা নোমান ফয়েজী, মাওলানা জমির উদ্দিন, মুফতি মোহাম্মদ আলীর প্রমুখের চেষ্টা ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নুরানি তালিমুল কোরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ’। হাটহাজারী মাদরাসার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ বোর্ড প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)-এর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় বোর্ডের কার্যক্রম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বোর্ডের প্রধান কার্যালয় হাটহাজারী মাদরাসায় অবস্থিত। দেশব্যাপী ৯টি নিজস্ব স্থায়ী ও ৩২টি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ সেন্টার মিলিয়ে ৪১টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ১৪ হাজার ১০৫টি নিবন্ধিত নুরানি মাদরাসাসহ প্রায় ২৬ হাজার মাদরাসা এ বোর্ডের সিলেবাসে পাঠদান করছে এবং ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী প্লে থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৫ জন ছাত্রছাত্রী নুরানি বোর্ডের অধীনে পড়াশোনা করেছে।

বর্তমানে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা খলিল আহমেদ কাসেমী এবং মহাসচিব মুফতি জসীমুদ্দীন বোর্ডের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করছেন।

মাদরাসার মুখপত্রের ৯০ বছরের পথচলা

দারুল উলূম হাটহাজারীর মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম, যা সর্বপ্রথম মাওলানা আবুল ফারাহ মেখলীর সম্পাদনায় ‘ইছলাম প্রচার’ নামে রেঙ্গুন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কোরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা, ইসলামি সংস্কৃতি ও সামাজিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ এবং দলিলভিত্তিক মতামত প্রদান এ পত্রিকার মূল লক্ষ্য। ১৯৩৫ সাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির বর্তমানে অর্ধ লাখ পাঠক রয়েছে।

বর্তমানে মাসিক মুঈনুল ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মুনির আহমদ দায়িত্ব পালন করছেন। তার দক্ষ সম্পাদনায় পত্রিকাটি একদিকে যেমন ধর্মীয় জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রসমাজের অসংগতি নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকাটি প্রিন্ট সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইনেও পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

আল্লামা আহমদ শফী ও হেফাজতে ইসলাম

কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী মাদরাসা। তবে এ মাদরাসার পরিচিতি এবং প্রভাব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের লংমার্চের পর।

হেফাজতে ইসলামের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.), হাটহাজারী মাদরাসার পরিচিতি বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এদিকে হেফাজত আন্দোলনের মূল কেন্দ্র হাটহাজারী মাদরাসায় হওয়া এবং দীর্ঘ দুই দশক হেফাজত আমির-মহাসচিবের একই মাদরাসায় অবস্থানে সরকার ও দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে হাটহাজারী মাদরাসা।

হাটহাজারীর মন্দির-মসজিদ : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির

বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বহুকাল ধরে এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে। যদিও কখনো কখনো কিছু চিহ্নিত দেশি-বিদেশি মিডিয়া বিশেষত ভারতীয় মিডিয়াগুলো বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচার চালায়, বাস্তবতা এসব দাবির বিপরীত। এ দেশের নানা অঞ্চলে মন্দির ও মসজিদের পাশাপাশির অবস্থান এবং উভয় ধর্মাবলম্বীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তার উদাহরণ।

হাটহাজারী মাদরাসার কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই অবস্থিত শ্রী শ্রী কেন্দ্রীয় সীতাকালী মন্দির। এটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত।

২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় মাদরাসাছাত্ররা মন্দির, থানা ও সরকারি অফিসগুলোয় পাহারা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে।

আগ্রহ-আবেগের ঠিকানা মাদরাসার কবরস্থান

দেশি-বিদেশি অতিথি এবং হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছে এক আবেগময় গন্তব্য হলো মাকবারায়ে জামিয়া, যা হাটহাজারী মাদরাসার কবরস্থান নামেই পরিচিত। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হাটহাজারীর শীর্ষস্থানীয় আলেমরা, যারা বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন, ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার অগ্রযাত্রায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন।

এই কবরস্থানে শায়িত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফী (রহ.), শাইখুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.), মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী (রহ.), আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.), আল্লামা হারুন (রহ.), মুফতি নুর আহমদ (রহ.)-সহ হাটহাজারী মাদরাসার আরো বহু প্রখ্যাত শিক্ষক। প্রতিদিন ফজর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জিয়ারতকারীদের পদচারণে মুখর থাকে এ স্থান।

জুলাই বিপ্লবের সমর্থন ও ভারতবিরোধী অবস্থানে সরব

হাটহাজারী মাদরাসা বাংলাদেশের শুধু ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদাই অর্জন করেনি, বরং এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতেও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে।

ভারতীয় আগ্রাসন এবং ইসলামবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা সদা প্রস্তুত। ২০২১ সালে ভারতের গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঝড় উঠেছিল। সে সময় হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররাও মিছিল ও প্রতিবাদে অংশ নেন। এই প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে হাটহাজারী মাদরাসার চারজন ছাত্র শহীদ হন এবং শতাধিক আহত হন।

হাটহাজারী মাদরাসা শুধু ভারতীয় আগ্রাসন নয়, বরং দেশের মধ্যে যেকোনো ইসলামবিরোধী আইন, শিক্ষানীতি, ফতোয়াবিরোধী কার্যক্রম এবং নবীবিদ্বেষী বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

বিশেষত ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পর, দেশব্যাপী ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে সমাবেশ ও বিক্ষোভের ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করেছে হাটহাজারী মাদরাসা। এ মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা চব্বিশের জুলাই বিপ্লবেও সরব ভূমিকা পালন করে।

আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী

মহাপরিচালক, দারুল উলূম হাটহাজারী

দারুল উলূম হাটহাজারী দেশের বৃহৎ শতবর্ষী ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জামিয়ার যোগ্য ছাত্রদের বিস্তৃত কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্রদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটাতে এবং জাতির ধর্মীয় সমস্যাবলির সমাধানে জামিয়ার কর্মপন্থা অনুকরণীয় এবং অবদান অনস্বীকার্য।

আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট নিরসন, হোস্টেলে খাবারের মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছি। আমরা যদি সার্বিক সুবিধা দিয়ে ছাত্রজীবনেই তাদের দক্ষ ও যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারা দেশ-বিদেশে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দিতে পারবে। এতে আমরা সবাই ইহ-পরকালীন সফলতা পাব বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি।

মুফতি কেফায়েতুল্লাহ

শিক্ষাপরিচালক, দারুল উলূম হাটহাজারী

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ, নতুন কিংবা পুরাতন সব সমস্যার সমাধান ইসলামেই রয়েছে। একমাত্র ইসলামই ইহকালীন শান্তি-শৃঙ্খলা এবং পরকালীন মুক্তি ও সফলতার পথ নিশ্চিত করেছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে আলেম সমাজকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই আমাদের পুরো জীবনের মিশন আর ভিশনই হলো যুগসচেতন যোগ্য আলেম তৈরি করা, যারা জাতির যেকোনো সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে সক্ষম হবে। দারুল উলূম হাটহাজারী শতাব্দী ধরে এ দায়িত্বটি পালন করে আসছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত