হাসপাতালেই সংক্রমণ, কাজ করছে না ওষুধ

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ১০: ০১
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ১০: ২৭
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক রোগী নতুন করে ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হচ্ছে। বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্য। ছবি: আমার দেশ

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক রোগী নতুন করে ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে, যারা ভর্তির সময় সে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ছিল না। এই ধরনের সংক্রমণ রোগীর সুস্থতার পথে বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কিডনি বা ক্যানসারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে এসে রোগীর স্বাস্থ্য আরো জটিল করে তুলছে এই সংক্রমণ। সম্প্রতি একটি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর মধ্যে এ ধরনের সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মালটি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতার সমস্যা।

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে থেকে উদ্ভূত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন এবং সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতা নিয়ে বিস্তারিত রিভিউ পেপার সম্প্রতি স্প্রিঞ্জার ন্যাচার প্রকাশনার ডিসকভার পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ‘দ্য বার্ডেন অব হসপিটাল-অ্যাকুয়ার্ড ইনফেকশনস অ্যান্ড অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ইন বাংলাদেশ : কারেন্ট ট্রেন্ডস অ্যান্ড পলিসি ইমপ্লিকেশনস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটিতে কাজ করেছেন বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক ডা. জুবায়ের জাজবী, ডা. নওশিন তাবাসসুম, গোলাম কিবরিয়া, ডা. আহসান আহমেদ, ড. মোহাম্মদ মেহাদি হাসান চৌধুরী ও ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন।

হাসপাতাল-উদ্ভূত সংক্রমণ ও অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতা সংকট

এ বিষয়ে গবেষক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন আমার দেশকে বলেন, হাসপাতাল-উদ্ভূত সংক্রমণ (এইচআইআই) এমন, যা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ঘটে। এ ধরনের সংক্রমণ সচরাচর সেই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু দ্বারা ঘটছে, যারা এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে সহনশীলতা অর্জন করেছে। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক সেসব জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর হয় না। ফলে সার্বিকভাবে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল সহনশীলতার বা এএমআর বিষয়টি আরো জটিল করে তুলছে।

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে হাসপাতাল-উদ্ভূত সংক্রমণের মূল কারণগুলো হলো হাসপাতালের খারাপ স্যানিটেশন, অতিরিক্ত ভিড়, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব এবং অকার্যকর পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। তিনি আরো বলেন, এই সমস্যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষত গরিব ও মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য চিকিৎসা খরচ বাড়াচ্ছে, ফলে স্বাস্থ্যসেবা আরো দুরূহ হয়ে পড়ছে।

অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতার সমস্যা ও পরিণতি

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতার মূল কারণ হলো বাছবিচারহীন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার। অনেক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছেন, যাতে ব্যাকটেরিয়ার সহনশীল হয়ে ওঠার পথ সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে সেফালোস্পোরিন ও ম্যাক্রোলাইডসের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এই সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, এই পরিস্থিতি শুধু হাসপাতালগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে এক গবেষণায় জানা যায়, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল সহনশীলতার কারণে দেশে প্রায় ২৬ হাজার ২০০ মানুষ মারা যাচ্ছে, যা একটি মারাত্মক সংকেত।

সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি

এ সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, হাসপাতাল স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা অপরিহার্য। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনায় কঠোর আইন এবং কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায়, বাংলাদেশ সরকার এএমআর মোকাবিলায় একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করছে।

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এএমআর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠছে অপ্রত্যাশিত প্রেসক্রিপশন প্যাটার্ন এবং ফার্মাসিস্ট ও জনসচেতনতার অভাবে। প্রায় এক লাখ ডোজ অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিতরণ করা হয়। তিনি বলেন, ফার্মেসিগুলোতে যোগ্য ফার্মাসিস্টের অভাব রয়েছে এবং অপ্রশিক্ষিত বিক্রয়কর্মীদের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহের প্রবণতা ব্যাপক। এমনকি অনেক ফার্মেসিতে ভুল নির্দেশনা দেওয়ার ফলে এএমআর পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে, দেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির অযাচিত প্রবণতা মোকাবিলায় ‘মডেল ফার্মেসি’ ব্যবস্থার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে ‘এ’ গ্রেড সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টদের দায়িত্বে রেখে সঠিক ওষুধ বিতরণের ব্যবস্থা করা। এটি ফার্মেসিগুলোর মান উন্নয়ন করবে এবং সঠিক পরামর্শ নিশ্চিত করবে।

তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার এএমআর প্রতিরোধে ‘অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল স্টিউয়ার্ডশিপ (এএমএস)’ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যা চিকিৎসকদের প্রমাণভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ দেবে।

সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে এএমআর এবং হাসপাতাল-উদ্ভূত সংক্রমণের সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ফার্মেসিগুলোতে সঠিক প্রশিক্ষণ এবং আইনগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ছাড়া চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এএমআর সম্পর্কিত শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ানো এবং সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। সমন্বিত উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এ সংকট সমাধান সম্ভব নয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত