এনআইসিইউতে নেওয়ার আগেই বাচ্চাটির মৃত্যু হয়

এন‌ আই মানিক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
অনামিকা রায়, সিনিয়র স্টাফ নার্স, ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, মগবাজার, ঢাকা

হাসপাতালে না গেলে এলে জীবন‌ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয় না। রোগীর বেঁচে থাকার আকুতি এবং নার্সদের ব্যস্ত হয়ে সেবা দেওয়ার দৃশ্যগুলো কখনো কখনো চিন্তা-ভাবনাকে জাগিয়ে দেয়। নীলফামারীর মেয়ে অনামিকা রায়, প্রায় সাত-আট বছর আগে ছোট একটা অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। তিনি অনুভব করেন, নার্সরা সেবা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করে তুলছেন। অন্যদিকে অনেক রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার সময় নার্সদের বাহবা বা দোয়া করে দিচ্ছেন। এমন দৃশ্য অনামিকার চিন্তাশক্তিকে নাড়িয়ে দেয়। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মানুষের সেবা করবেন এবং পেশা হিসেবে এই নার্সিং পেশাকেই বেছে নেবেন।

বিজ্ঞাপন

অনামিকা বলেন, ‘এটা একটা মহৎ পেশা। আমার মনে হয়েছিল, আমি চাইলেই এই কাজটা করতে পারি। মানুষের উপকার করা এবং সেবা করাটা মহৎ উদ্যোগ। আর তাই সিদ্ধান্ত নিই নিজের ভবিষ্যতের সঙ্গে এই পেশাকে জড়ানোর। বাবা-মাকে জানানোর পর পূর্ণ সাপোর্ট পাই। তারাও চেয়েছেন, আমি মানবসেবায় নিয়োজিত থাকি।’

নিজের ইচ্ছা আর বাবা-মায়ের সমর্থন পেয়ে মানবসেবার পথেই হাঁটেন অনামিকা। দিনাজপুর কেয়ার নার্সিং কলেজ থেকে কোর্স কমপ্লিট করে ঢাকায় চলে আসেন। বর্তমানে মগবাজারের ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন। নার্সিং পেশার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাসিং একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। প্রথম দিন চিন্তা ছিল, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব তো? সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আসলে কেমন হবে? এ বিষয়গুলো নিয়ে টেনশন ছিল। কিন্তু এখানে আসার পর দেখি, সবাই খুব হেল্পফুল এবং যথেষ্ট আন্তরিক। কীভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে হবে, কীভাবে রোগীর সমস্যাগুলো সমাধান করব—এমন অনেক বিষয় প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় জমা পড়ে।’

‘সাধারণত একজন রোগীর সঙ্গে নার্সের যদি যোগাযোগ ভালো না হয়, সেক্ষেত্রে ভালো সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একজন নার্স হিসেবে রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হয় এবং একজন রোগী আপনাকে কীভাবে মনে রাখবে বলে আপনি মনে করেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে অনামিকা বলেন, ‘নার্স হিসেবে রোগীর সঙ্গে আমাদের খুব আন্তরিক ও পেশাদার সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। যেমন, আমরা একটা রোগীর পাশে যাব, রোগীর দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনব। শোনার পর তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলব। তার সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে সমাধান করার চেষ্টা করব। এতে আমাদের নার্সদের প্রতি রোগীর ভরসা, বিশ্বাস ও আস্থা চলে আসবে। ওই রোগী যখন বাসায় যাবে, তখন ভাববে—ওই নার্সটা আমাকে সময়মতো ওষুধ দিত, কোনো সমস্যা হলেই সমাধান করে দিত; খুব আন্তরিক ছিল নার্সটা।’

‘হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে নার্সদের মাঝে মাঝে কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়, যে স্মৃতিগুলো কখনো ভুলতে পারে না তারা। আপনার নার্সিং ক্যারিয়ারে এমন কোনো ঘটনা আছে কী, যা আপনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়?’ এ প্রশ্নের জবাবে অনামিকা রায় বলেন, ‘এ পেশায় অনেক কিছু আছে, যা আমাদের ভুলে যেতে হয়। আবার এমন কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো কখনো চাইলেও ভুলে যাওয়া যায় না। তেমনি একটি বাচ্চার কথা মনে হলে প্রায়ই কষ্ট পাই। সাত মাসের একটি বাচ্চা ভর্তি ছিল। অপারেশনের পরদিন বাচ্চার মা খাবার খাওয়ালে তা শ্বাসনালিতে আটকে তৎক্ষণাৎ বাচ্চাটি মারা যায়। আমরা বাচ্চার মায়ের চিৎকার শুনে গিয়ে দেখি, বাচ্চাটি আর নেই। ওই বাচ্চার জন্য আমরা অনেকেই কেঁদেছি। আসলে বাচ্চাটির জন্য কিছু করার সুযোগই পাইনি—না পেরেছি এনআইসিইউতে নিতে, না পেরেছি কিছু করতে; মুহূর্তের মধ্যেই চলে গেল।’ ‘এরই মধ্যে ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে পাঁচ বছর পূর্ণ হলো অনামিকার। নতুনদের জন্য কী পরামর্শ দিতে চান?’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন যারা এই পেশায় আসবেন, বেশি বেশি প্রশ্ন করবেন। জানার ইচ্ছা থাকতে হবে। সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। রোগীর প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এককথায় বলতে হয়, আমাদের আপডেট থাকতে হবে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত