ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়ায় প্রয়োজন সচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫, ১১: ০৮

দেশে ডেঙ্গু, করোনা ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটি মশাবাহিত ভাইরাসঘটিত রোগ, যা একই বাহক ‘এডিস মশা’ দ্বারা ছড়ায়। উভয় রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলো একই রকম; যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি হওয়া। তবে চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধিগুলোয় তীব্র ব্যথা বেশি দেখা যায়, যা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে রক্তপাত ও শ্বাসকষ্টের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই রোগ দুটি প্রতিরোধে মশার কামড় থেকে বাঁচা এবং মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা জরুরি।

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গু জ্বর

প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডেঙ্গু আতঙ্ক ফিরে আসে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে; যেমন ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। চলতি সময়ের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই চারটি ধরনের মধ্যে সবচেয়ে তিনটি ধরন বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে ডেন-১, ডেন-২ ও ডেন-৩ সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে। আর ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাল সংক্রমণ, যা ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) দ্বারা সৃষ্ট। এই ভাইরাস A, B, C ও D—এই চারটি সেরোটাইপে (serotypes) বিদ্যমান। একবার কোনো ব্যক্তি কোনো একটি সেরোটাইপে সংক্রমিত হলে তার সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে জীবনভর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তবে অন্য সেরোটাইপের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না।

কারণ

*ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) প্রধানত এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস (Aedes albopictus) নামক মশা দ্বারা বাহিত হয়।

*এই মশা দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে এবং সাধারণত পরিষ্কার ও আবদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে।

*সংক্রমিত মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

*ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান লক্ষণগুলো হলো তীব্র জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি হওয়া।

*কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (Dengue Hemorrhagic Fever) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (Dengue Shock Syndrome) নামক মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেখানে রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মহীনতা হতে পারে।

*ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।

রোগ নির্ণয়

*ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়, যা ভাইরাসের অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি শনাক্ত করতে পারে।

প্রতিরোধ

*মশার বিস্তার রোধ করা এবং মশা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত স্থানগুলো ধ্বংস করা প্রয়োজন। যেমন ফুলের টবে জমা পানি, বাতিল টায়ার ও অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে।

*ব্যক্তিগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দিনে ও সন্ধ্যায় মশা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ফুলহাতা জামাকাপড় পরা, মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করা এবং ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত।

চিকুনগুনিয়া

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাল রোগ, যা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা ছড়ায়। এটিও এডিস মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও মূলত এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) ও এডিস অ্যালবোপিকটাস (Aedes albopictus) মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাগুলো দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে এবং পরিষ্কার ও আবদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

*চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রধান লক্ষণগুলো হলো হঠাৎ জ্বর, তীব্র অস্থিসন্ধি ব্যথা (বিশেষ করে হাত ও পায়ের), মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি হওয়া।

*এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অস্থিসন্ধিগুলোয় তীব্র ব্যথা, যা কয়েক সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

*কিছু ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়ার কারণে স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, যেমন—মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিস হতে পারে।

চিকুনগুনিয়া নির্ণয়

চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রধানত দুটি পরীক্ষা করা হয়। একটি হলো RDT (র‍্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট)। এই পরীক্ষায় দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায় এবং এটি সাধারণত রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে করা হয়।

এ ছাড়া RT-PCR (রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) করা হয়। এই পরীক্ষাটি আরো সুনির্দিষ্ট এবং সাধারণত রোগের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে করা হয়।

চিকুনগুনিয়ার প্রতিকার

*চিকুনগুনিয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। রোগের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ অনুযায়ী হয়ে থাকে।

*পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

*জ্বর ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যাসপিরিন-জাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।

*প্রচুর পরিমাণে জল, ফলের রস ও অন্যান্য তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত।

*মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মশারি ও মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করা উচিত। বাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া যাবে না।

*চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, পরিবেশদূষণ ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের বেশ কিছু সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। অথচ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা। একটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্য, গড় আয়ুসহ অনেক কিছুই নির্ভর করে সে দেশের পরিবেশের ওপর। বর্তমানে দেশে পরিবেশের যে অবস্থা, তা শুধু চিন্তিত হওয়ারই নয়, বরং উদ্বেগেরও। তা ছাড়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণ। বৃক্ষ যেমন পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সহায়তা করে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা পেতে সহায়তা করে। কিন্তু আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলছি। নিষিদ্ধ পলিথিন-জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার এবং অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমেই আমাদের মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে শব্দদূষণ তেমন কোনো ক্ষতিকর মনে না হলেও তা মানুষের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। আর অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশা নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ। আবার বিশেষ করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও কোভিড-১৯-এর নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। জুন থেকে অক্টোবর সময়কালকে ভাইরাস জ্বরের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। তাই চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা ও মানুষের পাশাপাশি অন্য উৎসগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে, সংক্রমণের সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। যেমন—বন-জঙ্গলে থাকা এডিস মশা ও অন্যান্য মশায় এ রোগের জীবাণু আছে কি না, তা শনাক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে যে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু ভাইরাস রয়েছে, এগুলোর জিনগত বৈচিত্র্য নিরূপণ করা প্রয়োজন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত