প্রজনন শিক্ষায় উপেক্ষিত কিশোররা, বাড়ছে ভ্রান্ত ধারণা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০: ৪১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পারিবারিকভাবে কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলেও উপেক্ষিত কিশোররা। খোদ পাঠ্য বইয়ে গুরুত্ব পায়নি ছেলেদের প্রজন স্বাস্থ্যশিক্ষা। এতে করে বেশিরভাগ তরুণই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য জানতে না পারায় প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বাড়ছে।

রাজধানীর হোটেল সারিনাতে ইয়ুথ পলিসি ফোরাম এবং ঋতু হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের আয়োজিত “ভয়েস ইন ট্রানজিশন: ব্রিগিং অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথ অ্যাসপিরেশনস” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের নির্বাহী পরিচালক আমের মুস্তাক আহমেদ বলেন, “প্রজনন-স্বাস্থ্য বিষয়ে বয়সন্ধিকালে আমাদের কিশোর-কিশোরীরা সঠিক দিকনির্দেশনা পায় না। তারা যে তথ্যগুলো পেয়ে থাকে, সেগুলোর বেশিরভাগই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে আসে না, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে।’

ঋতু হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ইয়ুথ লিডার মেহেদী হাসান স্বাগত বক্তব্যে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, “ছেলে হয়ে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সময় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হয়। তবে ঋতু আমাকে পলিসিগত দিক এবং বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতায় সহায়তা করেছে।’

আরএইচআরএন’র ইয়ুথ এম্বাসেডর লাবিবা আহমেদ জানান, ‘স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বই থাকলেও সেটি না পড়ানোর কারণে তিনি কৌতূহলী হয়ে এই প্লাটফর্মের সাথে যুক্ত হন। তিনি বলেন, “এই প্লাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়ে সমাজে পুরুষদের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত অনেক ভ্রান্ত ধারণা ভেঙেছে।”

ইয়ুথ পলিসি ফোরামের রিসার্চ লিড ফারহান আহমেদ বলেন, ‘পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীদের জন্যও সহায়ক হয় এবং এতে সম্মতি, অহিংসা ও ক্ষতিকর সামাজিক নিয়ম নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। তবে তিনি উল্লেখ করেন, নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে পুরুষদের প্রজনন স্বাস্থ্য এখনো উপেক্ষিত।’

তাসনিম শামস তার গবেষণা তুলে ধরে বলেন, কৈশোরকালে তরুণ-তরুণীরা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেলেও পর্যাপ্ত জ্ঞান পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহপাঠীরাই তাদের তথ্যের উৎস হয়ে ওঠে, যা সঠিক নয়। তিনি স্কুল ও পরিবারে এই বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বলেন, পাঠ্যপুস্তকে নারী-কেন্দ্রিক কিছু প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ছেলেদের প্রয়োজন ও চ্যালেঞ্জগুলো প্রায় উপেক্ষিত। এর ফলে, কি আমরা ছেলেদের জন্য নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছি?

ইউএনএফপিএ’র প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট ড. মুহাম্মদ মুনির হোসেন, এডোলেসেন্ট-বালকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ছেলেদের সেবা প্রাপ্তিতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রত্যাশা অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি এটিকে “জাজমেন্টাল ব্যবহার” হিসেবে উল্লেখ করেন, যা পরিবার থেকে শুরু করে কমিউনিটিতেও বিদ্যমান।

তিনি আরও বলেন, “ছেলেদের ভূমিকা শুধু মেয়েদের সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ নয় তাদের নিজেদের শারীরিক, মানসিক ও প্রজনন-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাও রয়েছে। এজন্য আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন সেগুলো ছেলেদের কাছে ওয়েলকামিং এবং অ্যাক্সেসযোগ্য হয়।”

কিশোরগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শমসুন্নাহার মাকসুদা জাতীয় কারিকুলামের সীমাবদ্ধতার দিকে আলোকপাত করে বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু অধ্যায় থাকলেও ছেলেদের বিষয়টি প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে, অনেক কিশোর সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য না পেয়ে অনিরাপদ উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়ে।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেরা অনেক সময় মনে করে প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু মেয়েদের বিষয়, যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।’তিনি জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ছেলেদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সরকার ও সিভিল সোসাইটিকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. রাহুল ম্যাথিউ বলেন, সমাজে পুরুষত্বের বিকৃত ধারণা (টক্সিক মাস্কুলিনিটি) ছেলেদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইতিবাচক প্যারেন্টিং এবং গৃহস্থালি কাজে ছেলেদের স্বাভাবিক অংশগ্রহণকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। এছাড়া, তিনি মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ও স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য করার বিষয়ে বলেন, “এটি শুধু মেয়েদের নয়, পুরুষদেরও জানার বিষয় যাতে তারা সচেতন ও সহায়ক হতে পারে।”

বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের জেন্ডার ও সিভিল সোসাইটির সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার মুশফিকা জামান সাতিয়ার প্রশ্ন তুলেন, প্রজনন-স্বাস্থ্য নিয়ে এত কাজ করার পরও আমরা কেন পিছিয়ে আছি? তাঁর মতে, গ্যাপটা মূলত নীতি বাস্তবায়নে। মানসিক বাধাগ্রস্ততার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে যে পুরুষতান্ত্রিক নর্মগুলো আছে, তা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। তাই নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। দেশের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখনো মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রিক, ফলে ছেলেদের অংশগ্রহণ ও প্রয়োজনগুলো অবহেলিত থাকে ‘

ঋতু হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শারমিন কবির নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকেই ঋতুর লক্ষ্য ছিল ছেলেদের যুক্ত করে প্রজনন-স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এজন্য বাবাদের জন্য বিশেষ মডেল গাইড তৈরি করা হয়েছে, যাতে পরিবার থেকেই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সূচনা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বাবাদের কেন্দ্র করে ভিডিও সিরিজ তৈরি করেছি, যাতে তারা সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারেন। পাশাপাশি, http://7teen.com/ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি যেখানে কিশোররা বয়সন্ধিকালের বিভিন্ন বিষয়ে নিরাপদ ও বিশ্বস্ত উৎস থেকে তথ্য পাচ্ছে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত