সাক্ষাৎকার

‘নাইট ডিউটিতে জানতে পারি বাসায় বাচ্চার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর’

সন্তান বড় হতে থাকলে মা-বাবার চিন্তার কমতি থাকে না। আদরের সন্তান কোথায় পড়াশোনা করবে? পড়াশোনা শেষেই বা কী করবে? এমন কত প্রশ্নই তাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। সাতক্ষীরার মেয়ে দীপা ঘোষ, গুলশানের সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। একসময় তার নার্সিং পেশা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ দীপার বাবার ইচ্ছা ছিল, তিন মেয়েকেই তিনি নার্সিংয়ে পড়াশোনা করাবেন। একদিন মেয়েরা নার্স হয়ে মানুষের সেবা করবে, এমন স্বপ্নই দেখতেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

দীপা ঘোষ বলেন, ‘বাবার অনুপ্রেরণাতেই আমি নার্সিং পেশায় এসেছি। তখন খুব ছোট ছিলাম, ওই সময়টায় আমার বড় বোন অসুস্থ ছিলেন। তাকে প্রতি মাসে একটি করে ইনজেকশন দেওয়া লাগত। বাবা চাইতেন, একজন রেজিস্ট্রার নার্সকে দিয়ে ইনজেকশন দিতে। ফার্মেসিতে গিয়ে ইনজেকশন দেওয়া—এটি বাবা পছন্দ করতেন না। তাই বোনকে খুলনার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে ইনজেকশন দেওয়াতেন। সেই থেকেই বাবার ইচ্ছা জাগে মেয়েদের নার্সিংয়ে পড়াশোনা করাবেন। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমরা নার্স হয়ে সেবা দেব, পাড়া-প্রতিবেশীর সেবা দেব, এমনকি হাসপাতালেও মানুষের সেবা দেব—এসব স্বপ্নই বুনতেন আমার বাবা।’

২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করার পর দীপার নার্সিং জীবনের জার্নি শুরু হয়। উত্তরার ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেখান থেকে তিন বছর মেয়াদি ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি’ কোর্স কমপ্লিট করেন। সেই থেকেই নার্সিং পেশায় যুক্ত হোন দীপা ঘোষ।

প্রথম দিনের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা একটু ভীতিকর ছিল আমার জন্য। যেহেতু আমার শুরুটা হয়েছিল করোনার মধ্যে, তখন সবার মধ্যেই একটা ভয় ছিল। আমার শিফট ছিল সকাল ৮-২টা পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের সুপারভাইজার এসে জানান, আমাকে ইভিনিং শিফটও করতে হবে। কারণ করোনা রোগীর চাপ অনেক বেশি ছিল। ওই সময় আমার খুব খারাপ লাগছিল, টানা ১২ ঘণ্টা কোনো খাবার বা পানি স্পর্শ করিনি। ভাইরাস খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে। গ্লাভস খুললে ভাইরাস ছড়াতে পারে, এই ভয়ে ওয়াশরুমেও যাইনি। এখনকার মতো ড্রেসে তখন ডিউটি ছিল না, আমাদের পিপি পরে থাকতে হতো। ডাবল গ্লাভস পরতাম, যেন ভাইরাস কোনোভাবে ছড়াতে না পারে।’

কোভিড আসলে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। ওই সময়টায় সবার মধ্যেই একটা আতঙ্ক ছিল। কাজের অভিজ্ঞতায় এমন কোনো ঘটনা আছে কি না, যা আপনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে দীপা বলেন, ‘অনেক ঘটনাই আছে। তবে একটি ঘটনা আমি কখনো ভুলব না। এখনো সাহাবুদ্দিন মেডিকেলের ৫১৯ নম্বর কেবিনের সামনে গেলে আমার কলিজা নড়ে ওঠে। এটিও কোভিডের সময়কার ঘটনা। সেখানে ৩৮ বছর বয়সি একজন রোগী ছিলেন। তার অক্সিজেন খুব কম থাকত, তিনি বুঝতেন যে অক্সিজেন ছাড়া একদম থাকতে পারতেন না। তাই আমরা যে শিফটের নার্সই তার কাছে যেতাম, তিনি বলতেন, নার্স আমি বাঁচব তো? আমাকেও তিনি অনেকবার বলেছেন একই কথা। আমি সবসময় পজিটিভ আশ্বাস দিতাম, বলতাম আপনি বাঁচবেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার খেলা তো বোঝা দায়। লোকটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন, আমার সামনেই মারা যান। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে আমাকে বলেছিলেন, সিস্টার আমি বাঁচতে চাই, আমি অনেক বড়লোক। গুলশানে আমার তিনটি বাড়ি আছে। আমি যদি বেঁচে যাই একটি বাড়ি আপনাদের নামে লিখে দেব। প্লিজ আমাকে বাঁচান। এমন আকুতি ছিল তার মধ্যে। ওই ঘটনাটি আমাকে খুব নাড়া দেয়।’

নার্সিং একটা মানবসেবামূলক পেশা। আর এই পেশায় কাজ করলে দিনরাত পরিবারের সদস্যদের থেকেও দূরে থাকতে হয়। নার্সদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নাইট ডিউটি করা। বিশেষ করে যারা বিবাহিত, তাদের জন্য এটি চ্যালেঞ্জিংও বটে। তাই এই পেশায় কাজ করে পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাটা কতটা কঠিন? আপনি কীভাবে সামলান? এই প্রশ্নগুলোর জবাবে দীপা ঘোষ বলেন, ‘আসলে ব্যক্তিগত জীবন আর পেশা সামলাতে আমরা হিমশিম খাই। কিছুদিন আগের কথাই বলি, এখনো সেই ভাইরাল ফিভারটি আছে। চলতি মাসের ৪ তারিখেই নতুন একটা রোগী ভর্তি হয়। আমার তখন নাইট ডিউটি ছিল। ১০৪-এর ওপর জ্বর। কোনোভাবেই আমরা তার জ্বর কমাতে পারছিলাম না। রোগী খুব কাতরাচ্ছিল, আমি তখন বাধ্য হয়ে ওই রোগীর মাথায় পানি দিই, জ্বর কমানোর সব চেষ্টাই করি। তখন রাত ২-৩টা পর্যন্ত আমার স্বামী অনেকগুলো ফোন দিয়েছেন, কিন্তু আমি রিসিভ করতে পারিনি। পরে কল ব্যাক করে জানতে পারি আমার বাচ্চার ১০৪ জ্বর। ওই সময়টায় খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবু নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে পরামর্শ দিই বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় মেডিসিন দেওয়ার জন্য। এটাই আমাদের নার্সিং লাইফ। অনেক সময় নিজেদের জ্বর নিয়েই রোগীর সেবা করতে হয়।’

নার্সিং পেশায় বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক স্টুডেন্ট আগ্রহ নিয়ে আসে। বেড়েছে নার্সিং কলেজের সংখ্যাও। পাঁচ বছরে আপনি নার্সিং পেশায় কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান? এ প্রশ্নের জবাবে দীপা বলেন, ‘আমি বলতে চাই, নার্সরা আগের মতো এখন পিছিয়ে নেই। নার্স মানেই যে খাতা-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এমনটা না। এই ক্ষেত্রে আইটি বা কম্পিউটারকেন্দ্রিক ব্যবস্থা থাকলে আমাদের সময় বাঁচবে। এখন আমরা খাতা-কলমে কাজ করি, কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজগুলো করা গেলে আরো সহজ হতো। আইটি সম্পর্কে আমাদের ধারণাও বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া সময় বাঁচলে আমরা রোগীদের সেবা আরো বেশি দিতে পারব।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত