স্মার্টফোন আজ শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়। ব্যাংকিং, ব্যবসা, সামাজিক যোগাযোগ, কেনাকাটা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মুহূর্ত, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। আর এই অসংখ্য সুবিধার মধ্যেই অদৃশ্য এক ঝুঁকি দিন দিন বড় হচ্ছে। অ্যাপ পারমিশনের ফাঁদ। আমরা যখন কোনো অ্যাপ ইনস্টল করি, তখন ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, লোকেশন, কনট্যাক্ট ও স্টোরেজ। এমন সব অনুমতি চাওয়া হয়। যেগুলোর অনেকগুলোরই অ্যাপের মূল কাজের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকে না। বেশির ভাগ ব্যবহারকারী না ভেবেই ‘Allow’ চাপেন। আর এভাবেই ব্যক্তিগত তথ্যের দরজা খুলে যায় অজানা সব কোম্পানি ও ডেভেলপারদের কাছে।
বর্তমানে অনেক অ্যাপই ‘ডেটা-ড্রিভেন’ ব্যবসা মডেলের ওপর নির্ভর করে। মানে, আপনার তথ্যই তাদের আয়ের উৎস। আপনি কোন ওয়েবসাইটে যান, কোন দোকানে কেনাকাটা করেন, কোথায় গেলে বেশি সময় কাটান, কার সঙ্গে কথা বলেন। এসব তথ্য অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞাপন বিক্রি করা হয় বিভিন্ন সংস্থার কাছে। কিন্তু সমস্যাটি আরো গভীরে। কিছু অ্যাপ আবার এই ডেটা হস্তান্তর করে তৃতীয় পক্ষের কাছে। যাদের সম্পর্কে ব্যবহারকারী কিছুই জানেন না। ফলে অনুমতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ছবি, ভিডিও বা রিয়েল-টাইম লোকেশনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়।
ঝুঁকি শুধু ডেটা লিকেই সীমাবদ্ধ নয়। পারমিশন অপব্যবহার করে অনেক অ্যাপ ফোনকে ‘গোপন নজরদারি ডিভাইস’ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একটি সাধারণ ফটো এডিটর অ্যাপ যদি মাইক্রোফোন বা লোকেশন অ্যাক্সেস চায়। তখনই সন্দেহ হওয়া উচিত। মাইক্রোফোন অ্যাক্সেস পেলেই অ্যাপটি ব্যাকগ্রাউন্ডে অডিও রেকর্ড করতে পারে। আর লোকেশন অ্যাক্সেসের মাধ্যমে আপনার চলাচলের নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করতে পারে। সাইবার অপরাধীর হাতেও যদি এই তথ্য পৌঁছে যায়। তখন তা শারীরিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরে থাকা বহু জনপ্রিয় অ্যাপও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পারমিশন নেয়। অনেক অ্যাপ আবার এমনভাবে পারমিশন সাজায়, যাতে ব্যবহারকারী না দিলে অ্যাপ ঠিকমতো কাজই করে না। এই ‘ডার্ক প্যাটার্ন’ ডিজাইনের কারণে সাধারণ ব্যবহারকারী বাধ্য হয়ে সব অনুমতি দিয়ে দেন। অথচ অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএসে এখন পারমিশন ব্যবস্থাপনা আরো শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ব্যবহারকারীর অসচেতনতা বড় সমস্যা হয়ে আছে।
তাহলে সমাধান কী?
প্রথম ধাপÑসচেতনতা। অ্যাপ ইনস্টলের আগে রিভিউ পড়ুন। ডেভেলপার কোম্পানি সম্পর্কে জানুন এবং কোন পারমিশন আসলে প্রয়োজন তা বুঝে নিন। অ্যান্ড্রয়েডে ‘Privacy Dashboard’ এবং আইফোনে ‘App Privacy Report’ ব্যবহার করে কোন অ্যাপ কখন কোন পারমিশন ব্যবহার করছে, তা নজরে রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, লোকেশনÑসবসময় অন না রেখে ‘While using the app’ মোডে রাখুন। আর কোন অ্যাপ সন্দেহজনক পারমিশন চাইলে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করুন বা বিকল্প অ্যাপ ব্যবহার করুন।
এই ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্যই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। অথচ আমরা নিজের অজান্তেই প্রতিদিন এই তথ্য বিনামূল্যে দিয়ে দিচ্ছি বিভিন্ন অ্যাপকে। প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, ডেটার মূল্য তত বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিও। তাই অ্যাপ পারমিশন শুধু একটি প্রযুক্তিগত অপশন নয়, এটি আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তার সীমানা। সচেতন না হলে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। সবকিছুই হারিয়ে যেতে পারে অদৃশ্য ডেটা-শিকারিদের ফাঁদে।

