ডটকমের বিশাল দুনিয়া

পল্লব শাহরিয়ার
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৪১

ইন্টারনেটকে যদি আধুনিক সভ্যতার প্রাণ বলা হয়, তবে ‘.com’ হলো তার হৃৎস্পন্দন। আমরা যখন কোনো ওয়েবসাইটের নাম বলি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেষে একটি ‘.com’ বসে যায়। আজকের ডিজিটাল পৃথিবীতে এটি শুধু একটি ডোমেইন এক্সটেনশন নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির প্রতীক।

জন্মের পর থেকে চার দশক পার করে ‘.com’ এখনো ইন্টারনেট জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী ও পরিচিত নাম।

বিজ্ঞাপন

উৎপত্তি ও প্রথম যুগ

১৯৮৫ সালে যখন ‘.com’ প্রথম চালু হয়, তখন ইন্টারনেট ছিল শুধু কিছু গবেষক, সামরিক বাহিনী এবং বড় প্রতিষ্ঠানের হাতিয়ার। সে বছরই বিশ্বের প্রথম ডোমেইন হিসেবে রেজিস্ট্রার হয় symbolics.com। শুরুতে ‘.com’-এর উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি পরিচয় তৈরি করা। কিন্তু খুব দ্রুতই এটি ব্যবসার সীমা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ, তথ্যভান্ডার, শিক্ষা ও বিনোদনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘.com’ হয়ে ওঠে প্রতিটি ওয়েবসাইটের স্বাভাবিক গন্তব্য।

ডটকম বুম ও বুদবুদ

১৯৯৫ থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই বিশ্ব দেখল এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান—যাকে বলা হয় Dot-com boom। সেই সময়ে প্রযুক্তি কোম্পানি গড়ে ওঠা ছিল এক ধরনের উন্মাদনা। শুধু একটি ‘.com’ ডোমেইন কিনে, কিছু বিনিয়োগকারীর সমর্থনে রাতারাতি কোটি কোটি ডলারের শেয়ারবাজারে প্রবেশ করত নতুন কোম্পানিগুলো। তবে এই উত্থান ছিল এক ধরনের বুদবুদ। অনেক কোম্পানি প্রকৃত ব্যবসায়িক ভিত্তি ছাড়াই শুধু ওয়েবসাইট বানিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছিল। ২০০০ সালে এই বুদবুদ ফেটে গেলে অসংখ্য কোম্পানি ধসে পড়ে, বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ইতিহাসে এটি পরিচিত হয় Dot-com bubble burst নামে।

ডটকম যুগের শিক্ষা

যদিও সেই ধস ভয়াবহ ছিল, তবু এর মধ্য দিয়েই বিশ্ব শিখেছিল যে শুধু ওয়েবসাইট বানানো যথেষ্ট নয়—বাস্তব ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, টেকসই মডেল ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল জরুরি। এই শিক্ষা নিয়েই পরে জন্ম নেন আজকের প্রযুক্তি জায়ান্টরা। গুগল, আমাজন, ইবে, ইয়াহু—এরা বুদবুদের পরও টিকে যায় কারণ তাদের মডেল ছিল বাস্তবভিত্তিক ও গ্রাহককেন্দ্রিক।

বর্তমান প্রভাব

আজকের দিনে ‘.com’ ইন্টারনেটের প্রধান মুদ্রার মতো। আপনি যেই কোম্পানির ওয়েবসাইট বলুন না কেন—google.com, amazon.com, facebook.com, netflix.com—সবাই এই ডোমেইন ব্যবহার করে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিনোদন, শিক্ষা থেকে সংবাদ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘.com’ হলো আস্থার নাম। বর্তমানে প্রায় ১৬ কোটি বেশি ডটকম ডোমেইন সক্রিয় রয়েছে, যা একে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহৃত ডোমেইন এক্সটেনশন বানিয়েছে।

বাংলাদেশ ও ডটকম

বাংলাদেশেও ‘.com’-এর প্রভাব স্পষ্ট। ই-কমার্স সাইট যেমন দারাজ, আজকেরডিল বা চট্টগ্রাম-ঢাকার অসংখ্য অনলাইন শপ—সবাই তাদের ওয়েবসাইটে ‘.com’ ব্যবহার করে। উদ্যোক্তারা জানেন, ভোক্তার কাছে ‘.com’ মানে হলো বিশ্বস্ততা। এমনকি নতুন প্রজন্মের স্টার্টআপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিংবা ব্যক্তিগত পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এক্সটেনশন হলো ‘.com’। যদিও ‘.bd’ জাতীয় ডোমেইন ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পরিসরে যেতে উদ্যোক্তারা এখনো ‘.com’ কেই বেছে নেন।

ভবিষ্যৎ

আজকের দিনে নতুন ডোমেইন এক্সটেনশন যেমন ‘.ai’, ‘.app’, ‘.shop’ আসছে। এগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বিশেষায়িত সেক্টরে। কিন্তু গবেষণা বলছে, গ্রাহক এখনো বেশি ভরসা করে ‘.com’-এর ওপর। কারণ, এটি দীর্ঘদিন ধরে আস্থার প্রতীক। ভবিষ্যতেও ‘.com’ হারিয়ে যাবে না, বরং অন্য ডোমেইনের সঙ্গে সমান্তরালে আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।

উপসংহার

‘.com’ শুধু একটি টেকনিক্যাল এক্সটেনশন নয়; এটি এক যুগের ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেখিয়েছে কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবসা ও সমাজকে পাল্টে দিতে পারে। ডটকম যুগ আমাদের শিখিয়েছে উত্থান ও পতনের গল্প, শিখিয়েছে কীভাবে বাস্তব ব্যবসা গড়ে তুলতে হয়। আর আজকের দিনে এটি হয়ে উঠেছে আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য প্রতীক।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত