স্মার্টফোন এখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত হাতে থাকে ফোন। কাজ, বিনোদন, সামাজিক যোগাযোগ, এমনকি পড়াশোনাও এখন মোবাইলনির্ভর। কিন্তু এই অপরিহার্য যন্ত্রটির সঙ্গে লুকিয়ে আছে এক নীরব শত্রু। আর তা হলো- রেডিয়েশন। অনেকেই জানেন না, মোবাইল ফোন থেকে নির্গত অদৃশ্য রেডিও ওয়েভ বা বিকিরণ দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহে নানা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সচেতনতা জরুরি। কীভাবে আমরা ফোনের রেডিয়েশন কমিয়ে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, সেটিই জানা প্রয়োজন।
ফোনে কথা বলার সময় এটি মোবাইল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দিষ্ট মাত্রায় রেডিও ওয়েভ পাঠায়। এই প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। যা তাপ উৎপন্ন করে এবং আশপাশের টিস্যুর ওপর প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) এই রেডিয়েশনকে “সম্ভাব্য ক্যান্সারজনিত” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। যদিও এখনো সরাসরি ক্যান্সারের প্রমাণ মেলেনি। তবে গবেষণায় দেখা গেছে- অতিরিক্ত সময় ফোনে কথা বললে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, চোখ জ্বালা, এমনকি মেমোরি লসের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে সুখবর হলো- রেডিয়েশনের ঝুঁকি সম্পূর্ণ বন্ধ না করলেও তা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন কিছু সচেতনতা ও অভ্যাসের পরিবর্তন।
প্রথমত, ফোনে সরাসরি কানে ধরে কথা বলার বদলে হেডফোন বা স্পিকার মোড ব্যবহার করুন। এতে ফোনের রেডিয়েশন সরাসরি মস্তিষ্কে না গিয়ে দূর থেকে ছড়ায়। যা অনেকটাই নিরাপদ। সম্ভব হলে ওয়্যারলেস ইয়ারফোনের পরিবর্তে তারযুক্ত হেডফোন ব্যবহার করুন। কারণ ব্লুটুথ ডিভাইস থেকেও ক্ষুদ্রমাত্রার রেডিয়েশন নির্গত হয়। দ্বিতীয়ত, কল করার সময় সিগন্যাল দুর্বল থাকলে কথা বলবেন না। ফোন যখন সিগন্যাল পেতে কষ্ট করে, তখন এটি বেশি শক্তিতে রেডিও ওয়েভ প্রেরণ করে। ফলে রেডিয়েশনও বেড়ে যায়। তাই লিফট, বেইসমেন্ট বা দুর্বল নেটওয়ার্ক এলাকায় কথা বলা এড়িয়ে চলাই ভালো। তৃতীয়ত, ফোন ঘুমানোর সময় শরীরের কাছাকাছি রাখবেন না। অনেকেই বালিশের নিচে বা পাশে ফোন রেখে ঘুমান। এটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাসগুলোর একটি। রাতে ফোনকে অন্তত ২–৩ ফুট দূরে রাখুন এবং প্রয়োজনে এয়ারপ্লেন মোড চালু করে দিন।
চতুর্থত, রেডিয়েশন কম ফেলে এমন ফোন বেছে নিন। প্রতিটি ফোনের রেডিয়েশন মাত্রা নির্ধারণ করা হয় SAR (Specific Absorption Rate) দিয়ে। SAR মান যত কম, রেডিয়েশন তত কম। নতুন ফোন কেনার সময় ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইট বা বক্সে লেখা SAR মান দেখে নিতে পারেন। সাধারণত ১.৬ ওয়াট/কেজি-এর নিচে SAR মান হলে তা নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
পঞ্চমত, অপ্রয়োজনে ফোনে দীর্ঘক্ষণ স্ক্রলিং বা গেম খেলা থেকে বিরত থাকুন। যত বেশি সময় ফোন শরীরের কাছাকাছি থাকবে, রেডিয়েশনের প্রভাবও তত বাড়বে। মাঝে মাঝে ফোন থেকে বিরতি নেওয়া শুধু রেডিয়েশন কমায় না। মানসিক চাপও হ্রাস করে। এটিই হলো একধরনের “ডিজিটাল ডিটক্স।” এছাড়া, রেডিয়েশন শিল্ড কভার বা অ্যান্টি-রেডিয়েশন স্ক্রিন গার্ড ব্যবহার করাও কিছুটা কার্যকর হতে পারে। তবে এসব পণ্যের কার্যকারিতা ভিন্ন হতে পারে। তাই যাচাই-বাছাই করে নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড ব্যবহার করা ভালো।
সবশেষে মনে রাখা দরকার- রেডিয়েশন এমন এক বিষয়, যা আমরা দেখতে বা অনুভব করতে পারি না। কিন্তু এর প্রভাব নিঃশব্দে শরীরে জমে। প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে। তবে সচেতনতা ছাড়া সেটিই হয়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। তাই ফোন ব্যবহার করুন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। প্রয়োজনের সীমায় আর নিজের নিরাপত্তাকে রাখুন সর্বাগ্রে।

