আল মাহমুদ : বসন্তে বিপ্লবে

শাকিল মাহমুদ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫, ১৪: ৩০

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সাহিত্য সংগঠন ‘কালের কলস’-এর আয়োজনে বসন্তের মিঠা রোদের বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন কবিতাপ্রেমীরা। কালের কলসের পক্ষ থেকে সবার হাতেই বাসন্তী উপহার হিসেবে আল মাহমুদের প্রিয় লাল গোলাপ তুলে দেওয়া হয়। এরপর এক এক করে আসন অলংকৃত করেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারকী, কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার, কবি আবদুল হাই শিকদারসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।

বিজ্ঞাপন

কবি শাকিল মাহমুদ ও মুশফিকা নিপার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই বিপ্লবে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় ফাতেহা পাঠ ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর কালের কলস সম্পাদক, লেখক ও সাংবাদিক আবিদ আজমের স্বাগত বক্তব্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে কবির প্রয়াণ দিবস পালন না করায় ক্ষোভ জানিয়ে কবি আবিদ আজম বলেন, ‘বিগত স্বৈরাচারী সময়ে আল মাহমুদকে তুমুল অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়েছে। তার লাশ শহীদ মিনারে আনতে দেয়নি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তার দাফন নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। অথচ আজ সসম্মানে নানা মত-পথের মানুষকে একত্রিত করে এই শহীদ মিনারে এসেছেন, এটাই কবি আল মাহমুদের শক্তি। আবিদ বলেন, জুলাই আন্দোলনেও আমরা দেখতে পাই আল মাহমুদ কতটা প্রাসঙ্গিক। তার কবিতা জুলাই বিপ্লবে বিপুল ভূমিকা নিয়ে হাজির ছিল—‘পৃথিবীতে যত গোলাপ ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত/তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাস বায়ু।’ জুলাই বিপ্লবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন দেয়ালে শোভা পেয়েছে কবির এমন অনেক পঙ্‌ক্তি। অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তকে আল মাহমুদের কবিতা পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়ে সরকারিভাবে আল মাহমুদ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন তিনি; বলেন, বাংলাদেশপন্থি সংস্কৃতিকর্মীরা এমন এক বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যে তাদের ফেরার কোনো পথ নেই।

অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে অংশ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, কবি আল মাহমুদের বাড়ি সংরক্ষণের প্রসঙ্গটি দাবি তোলার বিষয় ছিল না, এটা মন্ত্রণালয় থেকেই হওয়া উচিত ছিল। পরিবারের সম্মতি পেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কবি আল মাহমুদের বাড়িতে স্মৃতি জাদুঘর ও মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, কবি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার রচনা, বাড়ি ও স্মৃতি আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা এবং ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। এ বিষয়ে আমাদের আগ্রহ আছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার এই কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করবে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, আল মাহমুদ কোনো রাজনৈতিক দলের নন, তিনি পুরো বাংলা ভাষার।

কবি আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, আল মাহমুদ যখন লিখলেন ‘সোনালী কাবিন’, তখন ‘কাবিন’ শব্দটি ভীষণভাবে সিগনিফিকেন্ট হয়ে ওঠে। এটা ছিল নতুন রাজনৈতিক আওয়াজ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আল মাহমুদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির হয়েছেন। সবার মাঝে তার চিন্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। জুলাই আন্দোলনে প্রমাণিত হয়েছে আমরা ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছি। ফরহাদ মজহার বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা পূর্ণ বিজয় পাইনি। ’২৪-এর বিপ্লব যেন বেহাত না হয়, এজন্য সাংস্কৃতিক লড়াই অবধারিত। এই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে শিল্পী, কবি ও সংস্কৃতিকর্মীদের।

সভাপতির বক্তব্যে কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেক কিছু স্বাধীন হয়েছে, শুধু সংস্কৃতি অঙ্গন স্বাধীন হয়নি। তবে শহীদ মিনারে আল মাহমুদকে নিয়ে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেই কষ্ট কিছুটা কমেছে। অবিলম্বে কবি আল মাহমুদের কবর রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কারের দাবি জানান তিনি। কবির মৃত্যুর পর তাকে শহীদ মিনারে আনতে না দেওয়া, গণকবরে দাফন করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না জানানোর কড়া সমালোচনা করেন বিপ্লবী এই কবি। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কতটা দুঃসময় ছিল তা মনে করলে গা শিউরে ওঠে। কবি আল মাহমুদকে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনতে চাইলে তাতে বাদ সাধে তৎকালীন স্বৈরশাসকের তল্পিবাহক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ওই সময়ের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুস গংরা।

আবদুল হাই শিকদার বলেন, সেদিন কবি আবিদ আজম এবং তার বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করেও ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবি আল মাহমুদকে দাফনের অনুমতি পাননি। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কবির নিজ বাড়ির আঙিনাতেও দাফন করতে দেওয়া হয়নি। আল মাহমুদকে যে গণকবরে রাখা হয়েছে, তার ওপরে আরো চারটি লাশ কবরস্থ করা হয়েছে, এটা কবির জন্য চরম অবমাননাকর।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকজয়ী আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন তার তোলা আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমানের একটি যুগল সাদাকালো ছবির স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ভাষা সংগ্রামী আল মাহমুদকে তিনি চিনতেন বামপন্থি সময় থেকেই। তারপর তার বিশ্বাস বদলেছে ঠিক। রাজধানীর শ্যামলীতে তিনি শামসুর রাহমানের বাড়িতে সেই ঐতিহাসিক ছবি তোলার স্মৃতিচারণ করেন এভাবে—‘ওই সময়ে বিশ্বাসের ভিন্নতা থাকলেও কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল, যার প্রমাণ ওই ছবিটা। কিন্তু এখন দিন দিন মতের ভিন্নতা হলেই শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। জুলাই বিপ্লব-উত্তর নতুন বাংলাদেশে এসব বন্ধ হওয়া জরুরি।’

কবি জাকির আবু জাফর বলেন, কবি আল মাহমুদ এদেশের মধ্যবিত্তের অবদমিত কাম-প্রেমের কথা তুলে এনেছেন বারবার। তিনি যখন বলেন, ‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/ দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর/লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/ হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর/।’ আল মাহমুদকে যতই অবজ্ঞা করা হোক, পুরো বাংলাদেশ ও মাটি-মানুষকে এক কাতারে নিয়ে এসেছেন আল মাহমুদ। তিনি চিরঞ্জীব হয়েই থাকবেন।

ড. কাজল রশীদ শাহীন বলেন, বইমেলায় আল মাহমুদসহ গুণীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, এর মাঝে বোঝা যায়, রাষ্ট্র সংস্কৃতি ধারণ করে কতটুকু। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরূপ আচরণের শিকার আল মাহমুদ। গণঅভ্যুত্থানের পরও যদি আল মাহমুদ যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হন, তাহলে আমাদের শহীদের ত্যাগ কীসের জন্য?

কবি শাহীন রেজা বলেন, বিরুদ্ধবাদীরা যত চেষ্টাই করুক কোনোভাবেই আল মাহমুদের মতো শক্তিশালী একজন কবিকে অস্বীকার করতে পারবে না।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ড. কুদরত ই হুদা, ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও কবি ইমরান মাহফুজ। ‘বিপ্লব বসন্তে আল মাহমুদ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে শুধু আলোচনাই ছিল না, ফাঁকে ফাঁকে ছিল আল মাহমুদের গান আর কবিতা আবৃত্তি। আল মাহমুদের গান পরিবেশন করেন সংগীতশিল্পী আমিরুল মোমেনিন মানিক ও জান্নাতুন নাঈম পিংকী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ফারাহ দোলন, শিমুল পারভীন, কামরুল ইসলাম জুয়েল, মুক্তা বর্মণ, কঠোর হাসান, মুসা আখন্দ, এম তারেক হাসিব, মনিরুজ্জামান পলাশসহ আরো অনেকে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

আল মাহমুদ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত