কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার কবি। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন বিনির্মাণের কবি। কবিতায়-গানে-গল্পে-উপন্যাসে-প্রবন্ধে সর্বত্রই জুলুমের বিরুদ্ধে উচ্চকিত তার বক্তব্য। বিশ্বমানবতার তিনি কণ্ঠস্বর। যেখানে মানুষ অধিকার বঞ্চিত, সেখানেই নজরুলসত্তা হিরণ্ময় প্রতিবাদী। তিনি সাম্যের ও স্বাধিকারের পক্ষে এবং বিভেদের বিপক্ষে স্লোগান তুলেছেন। জালিম শাসকের শাসনদণ্ড চিরতরে বিলোপ করার অভিপ্রায়ে ক্ষুরধার তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য তরুণ-যুবাদের উৎসাহ দিয়েছেন। পথে নেমে, পথে চলে, পথের দৃশ্য অবলোকন করে, পথেই সংগ্রাম শুরু করেছেন। মানুষ যেখানে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিগৃহীত, সেখানে নজরুল রাহবার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বৈষম্যের সমাজব্যবস্থা ভাঙার সুচিন্তিত বৈপ্লবিক রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। জাতীয় ও ব্যক্তিগত মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। একটি আদর্শ রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণের প্যাকেজ নজরুল সাহিত্য।
ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত করতে গিয়ে নজরুল সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেন। নবযুগ, ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। তার জ্বালাময় সম্পাদকীয়তে এ দেশের মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পায়। সাধারণ মানুষও আর সাধারণ থাকে না। সবাই দেশ বাঁচানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাকে জীবনের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করে। পত্রিকা কেনার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। নজরুল ১৯২২ সালে তার ধূমকেতু পত্রিকায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নজরুল যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন ভারতের বিখ্যাত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথিতযশা নেতারা জনসম্মুখে এসব আলোচনা করার সাহসও পেত না। নজরুল একের পর এক ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয় লিখে চললেন ধূমকেতুতে।
একইভাবে ২০২৪ সালের সমন্বয়করা যখন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন বাংলাদেশের বিরোধী দল নামে পরিচিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করার সাহস তো দূরে থাক মনোবাসনা পোষণ করত কি না, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। নজরুল লিখে চললেন ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয় আর আমাদের সমন্বয়করা লিখে চললেন একের পর এক দফা। একটার পর একটা আন্দোলনের রূপরেখা। নজরুল ঘোষণা করলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা; আমাদের তরুণরা ঘোষণা করলেন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, অর্থাৎ ভারতপ্রভাবিত ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে স্বশাসিত রাষ্ট্র বিনির্মাণের। রাজনীতিবিদরা মামলা-হামলার ভয়ে যখন গোপন গর্তে, তখন তরুণরা জীবন বাজি রেখে রাজপথে।
নজরুল জেলে গেলেন, অনশন করলেন, তবুও নমনীয় হলেন না। জুলাই বিপ্লবের সমন্বয়করা জেলে গেলেন, পুলিশের লাঠির নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হলেন, কিন্তু নমনীয় হলেন না।
নজরুল জেলে যাওয়ার আগে বহুসংখ্যক দেশপ্রেমী রেখে গিয়েছিলেন। আমাদের সমন্বয়করা আন্দোলন বেগবান করার জন্য স্তরে স্তরে নেতা রেখে গিয়েছেন, আর রেখে গিয়েছেন সমগ্র দেশবাসীকে। এক গ্রুপ জেলে গেলে, অন্য গ্রুপ দায়িত্ব নিয়ে বিপ্লব পরিচালনা করে। আর জাতি তাদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। নজরুলীয় চিন্তার এক অনন্য সংযোজন। নজরুলের সাহিত্য ও জীবন তাদের উদ্দীপনা দিয়েছে। নজরুল তার রুদ্র মঙ্গল গ্রন্থের ‘স্বাধীন চিত্ততা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন—‘সকল ভীরুতা, দুর্বলতা, কাপুরষতা বিসর্জন দিতে হবে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নয়, ন্যায়ের অধিকারের দাবিতেই আমাদিগকে বাঁচতে হবে। আমরা কারও নিকট মাথা নত করব না। এই স্বাধীন-চিত্ততার জাগরণ আজ বাঙলার মুসলমান তরুণদের মধ্যে দেখতে চাই। ইহাই ইসলামের শিক্ষা; এ শিক্ষা সকলকে গ্রহণ করতে বলি। আমি আমার জীবনে এ শিক্ষাকে গ্রহণ করেছি। দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি, কিন্তু আত্মার অবমাননা কখনো করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনো বিসর্জন দিইনি। “বলো বীর, চির উন্নত মম শির”—এ গান আমি আমার এ-শিক্ষার অনুভূতি হতেই পেয়েছি। এই আজাদ-চিত্তের জন্ম আমি চাই। ইসলামের ইহাই সর্বশ্রেষ্ট বাণী—ইসলামের ইহাই মর্মকথা।’
নজরুল চেয়েছিলেন সব ধর্ম, মত ও পথের মানুষকে একই কাতারে নিয়ে আসতে। যদি সবাইকে একই দীক্ষায় দীক্ষিত করা যায়, তবে বিপ্লবের কাজ আঞ্জাম দেওয়া সহজ হয়ে যায়। তাই নজরুল তার সাহিত্যে ও জাতীয় জীবনে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের ঐক্য কামনা করেছেন। দেশের ও মানবতার স্বার্থে সবাইকে একই মঞ্চে সমবেত করতে চেয়েছেন। সে যাত্রায় বড্ড বেদনা ও যাতনা সহ্য করতে হয়েছিল কবিকে। কেউ কাফির উপাধি দিয়েছেন, কেউ যবন। কোনো কিছুই কবিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কবি মুক্তকণ্ঠে যুগবাণী গ্রন্থের ‘নবযুগ’ প্রবন্ধে জনতাকে ডাক দিয়েছিলেন—
‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ, এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’
সে ডাকে এমন মায়া ও ভালোবাসা জড়ানো যে, এ দেশের সাধারণ মানুষ তাতে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি। আমাদের তরুণ ও যুবা সমন্বয়করা সব ধর্ম-মত-পথের মানুষকে দেশ রক্ষার্থে এবং বৈষম্য নিরসন করতে ডাক দিয়েছে। সে ডাকে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল, ছিল দেশের প্রতি আনুগত্যবোধ। সুতরাং সে ডাকে সাড়া না দিয়ে মানুষ থাকতে পারেনি। মা তার সন্তানকে নিয়ে মিছিল করেছে। বাবা তার সন্তানকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে গুলি বুকে নেওয়ার জন্য। এমন নজির বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। স্বামী স্ত্রীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে, স্ত্রী স্বামীকে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বামী-স্ত্রী-সন্তান সবাই মিলে যুদ্ধে গিয়েছে। পৃথিবীকে যুদ্ধের এক অভিনব সমর্থন দেখাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। নিজ দেশকে নিজের মতো করে পরিচালনা করার জন্য মানুষ মরতেও ভয় পায়নি। মৃত্যুভয় একেবারেই উঠে গিয়েছিল, যার জন্য স্বৈরাচারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে পুলিশকে বলতে শোনা যায়, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।’
নজরুলীয় চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ এই জনতাকে রুখে দেওয়ার সাধ্য কারও ছিল না। এমন মৃত্যুকে গ্রহণ করতে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের তরুণ ও যুবসমাজ। সত্যকে সত্য বলার এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার এই উদ্দীপনা তৈরিতে অবদান রেখেছেন নজরুল। তিনি রুদ্র মঙ্গল কাব্যের ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন—
‘মিথ্যাকে মিথ্যা বললে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বললে যদি নির্যাতন ভোগ করতে হয়, তাতে তোমার আসল নির্যাতন ঐ অন্তরের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। প্রাণের আত্মপ্রসাদ যখন বিপুল হয়ে ওঠে, তখন নির্যাতকের আগুন ঐ আনন্দের এক ফুঁতে নিবে যায়। ইব্রাহিম যখন বিদ্রোহী হয়ে নমরুদের অত্যাচারকে অত্যাচার আর তার মিথ্যাকে মিথ্যা বলে প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন, তখন নমরুদ তাঁকে ধরে এক বিরাট অগ্নি-জাহান্নামের সৃষ্টি করে তাতে নিক্ষেপ করল। কিন্তু ইব্রাহিমের কোথাও ফাঁকি ছিল না বলে সত্যের জোর ছিল বলে তাঁর আত্মপ্রসাদ ঐ বিপুল আনন্দের এক ফুঁতে সমস্ত জাহান্নাম ফুল হয়ে হেসে উঠল। ইব্রাহিমের মনে যদি এতটুকু ফাঁকি থাকত, তবে তখনই নমরুদের আগুন তাকে ভস্মীভূত করে দিত।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা ইব্রাহিমের মতো সত্যে অটুট ছিল বলেই এত বড় দুঃসাধ্য কাজকে সহজে সমাধা করতে পেরেছে। জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে পেরেছে। আপন মহিমা ঘোষণা করতে পেরেছে। পেরেছে জাতিকে দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা করতে; মানুষের মনে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে।
শান্তির সুবাতাস আনতে গিয়ে তাদের ক্ষণে ক্ষণে আন্দোলনের মোড় পরিবর্তন করতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গি সংগঠন ছাত্রলীগের পাণ্ডারা, যাদের হাতে অহরহ খুন লেগে আছে। মানুষের রক্ত নিয়ে যারা হোলি খেলে, এমন নির্মম দানব বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে বাংলাদেশে তরুণ ও যুবসমাজ। তারা শুরু করল বাংলা ব্লকেট। আন্দোলনের নতুন পরিভাষা। স্বৈরশাসক পরিভাষা বোঝার আগেই জাতি জেগে গেল, লুফে নিলো এ পরিভাষা। আন্দোলন যখন চরম তুঙ্গে তখন ঘোষণা দেওয়া হলো—সবার প্রোফাইল পিকচার লাল করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ আন্দোলনের নতুন সংযোজনের জন্য এমন প্রস্তাব উত্থাপন করলে সবাই তা মেনে নেয়। আন্দোলনের রং হয় রক্তের রং। লাল হয় তাদের মননজাত পতাকা। পুরো বাংলাদেশ তাতে সায় দেয়। ফ্যাসিস্টরা ভয়াবহ আতঙ্কে পড়ে যায়। বিপ্লব মোকাবিলা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তরুণদের যুদ্ধ এবং পতাকার রং নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নিশান বরদার’ প্রবন্ধে তরুণ-যুবাদের আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন—
‘আমাদের বিজয় পতাকা তুলে ধরবার জন্য এসো সৈনিক। পতাকার রং লাল, তাকে রং করতে হবে খুন দিয়ে। বল আমরা পেছাব না। বল আমরা সিংহশাবক, আমরা খুন দেখে ভয় করি না। আমরা খুন দিয়ে খেলা করি, খুন নিয়ে কাপড় ছোপাই, খুন দিয়ে নিশান রাঙ্গাই। বল আমি আছি, আমি পুরুষোত্তম জয়। বল মাভৈঃ মাভৈঃ জয় সত্যের জয়।’
নজরুলের প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। নজরুল তাদের চেতনার খোরাক জুগিয়েছেন, চিন্তার সমৃদ্ধি এনে দিয়েছেন। আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরির প্রভাবক হয়েছে। ভয়কে জয় করতে সহায়ক হয়েছে।
রুদ্র মঙ্গল গ্রন্থের ‘তরুণের সাধনা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন—
‘বার্ধক্যকে সবসময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কালমূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতি-বেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মার্তণ্ড প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরটা যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুঈনদের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরের সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-জগলুল-সানইয়াৎ-লেনিনের শক্তিতে।
এ প্রবন্ধ পড়ার পর কোনো মানুষের পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব নয়। আর যুদ্ধের পরিস্থিতিতে যদি এ প্রবন্ধ কারো পড়া থাকে বা কেউ মনে করিয়ে দেয়, তাহলে রক্ত গরম হয়ে উঠবে যেকোনো সত্যসন্ধানী মানুষের। এ প্রবন্ধ যেহেতু একাদশ শ্রেণিতে পাঠ্য ছিল, তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই এ প্রবন্ধ পড়া ছিল। বিপ্লবের তেজকে প্রবল প্রভাবিত করেছে নজরুলের লেখনী।
চলবে...

