অনলপ্রবাহ প্রকাশিত হলো ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১) বয়স তখন ১৯ পেরিয়েছে। জাতীয় উজ্জীবন ও স্বাধীনতার রণদামামা ছিল কবিতায়। সমাজে তৈরি হলো আলোড়ন। শহর থেকে গ্রামের বাতাসে দাউদাউ করছে পঙ্ক্তিমালা। ১৯০৮ সালের শেষদিকে বইটির বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হলো। ইংরেজ সরকার বরদাশত করতে পারল না, বইটি বাজেয়াপ্ত করল। কবির বিরুদ্ধে জারি করল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সিরাজী আত্মগোপন করলেন চন্দননগরে। ফরাসি-অধিকৃত এলাকাটিতে থাকলেন আট মাস। সেখানেও স্বস্তি ছিল না। একপর্যায়ে তিনি পাহাড়-জঙ্গলেও আত্মগোপন করেন। ভীতিকর ও অনিশ্চিত সেই সময়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র (১৮৬৫) প্রতিক্রিয়ায় লেখেন ‘রায়নন্দিনী’ (১৯১৫) উপন্যাস, আরো বহু রচনা। পরিকল্পিত রচনা যখন শেষ হলো, আত্মসমর্পণ করলেন।
স্বাধীনতার জন্য উপমহাদেশের প্রথম কবি হিসেবে কারাবন্দি হন তিনি। দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয় তার বিরুদ্ধে।
এতে তাকে দমানো যায়নি একবিন্দুও। পরবর্তী সময়ে তার বিরতিহীন লড়াই এত তীব্র ও প্রভাবক ছিল, যার ফলে ব্রিটিশ সরকার জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করে । একে একে তার ‘নব উদ্দীপনা’, ‘উচ্ছাস’, ‘উদ্বোধন’ গ্রন্থও বাজেয়াপ্তির কবলে পড়ে ।
এই ভূমি ও ভাষা ছিল তার একান্ত আপন। এর জন্য সংগ্রামের তরঙ্গশীর্ষে তৈরি করলেন নিজের নীড়। জাগরণের অগ্নিবাণী নিয়ে চারণের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন জনপদে জনপদে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি ছিল তার অন্বেষা। তার বহুমুখী সাহিত্যকর্ম অবিরল অঙ্কন করেছে জাতীয় পুনর্জাগরণ ও স্বাধীনতা অর্জনের পথ। একজন কবি, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পর্যটক, বাগ্মী ও সমাজ সংস্কারক পরিচয় তাকে পুরোপুরি বহন করে না। কারণ তিনি ছিলেন এক যুগনির্মাতা।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (১৮৯২-১৯৬৩) জবানীতে ব্যাপারটা পরিষ্কার । তিনি লেখেন, ‘একটি সুপ্ত জাতিকে কলঙ্কলিপ্ত করিতে না দেওয়া এবং ঘুমন্ত জাতিকে জাগাইয়া অতীত গৌরবের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করিবার কঠিনতম পথে একাকী তিনি অগ্রসর হইয়াছিলেন। আমাদের তরুণ বয়সে তাহার ‘অনল প্রবাহ’ রক্তে রক্তে বিদ্যুতের সঞ্চার করিয়াছিল (৫ মার্চ, ১৯৪৬)।’ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) লেখেন, ‘আমাদের সময়ে ব্যক্তিগত প্রতিভা, সদ্গুণ ও সুসম্পন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদিগের মধ্যে সিরাজী সাহেব ছিলেন অগ্রণী।... দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও বালিকাদিগের শিক্ষার জন্য বেসরকারি ব্যক্তিদিগের মধ্যে সৈয়দ... সিরাজী সাহেব ছিলেন প্রথম সারির প্রথম মানুষ।... মুসলিমবিদ্বেষী লেখকদিগের সঙ্গে সংগ্রামে সৈয়দ... সিরাজী সাহেব ছিলেন কবি, লেখক ও সাহিত্যিকগণের সেনাপতি। দেশের চাষী, মজুর ও ঘাতকদিগের দুর্দশা মেটানোর জন্য সৈয়দ... সিরাজী সাহেবের কণ্ঠেই আকুল আহ্বান আমরা শুনিয়াছিলাম।’
সিরাজগঞ্জ জেলার দিয়ারধানগড়ায় জন্মগ্রহণ করে মাত্র ৫১ বছরের একটা জীবন তিনি যাপন করেন। লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত, কিন্তু রপ্ত করলেন আরবি, উর্দু, ফার্সি, সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্য। কোরআন, হাদিস, দর্শন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রতত্ত্বে তার অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ তার রচনারাজি। একই সঙ্গে বেদ, উপনিষদ, মনুস্মৃতি, গীতা ও বাইবেলেও অর্জন করেন প্রবল প্রাজ্ঞতা। তার নিকটবর্তী দিশারি ছিলেন বাঙালি মুসলিমের কালো রাতের পাঞ্জেরী মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭)।
পরাধীন, ক্ষয়িষ্ণু ও ভঙ্গুর মুসলিম সমাজের অসহায়ত্ব ছিল তার কাছে পরিষ্কার। শোষণ-বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার অন্ধকার জাতীয় জীবনে। মুসলিমদের আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বিপন্ন। অধঃপতিত সমাজের ব্যথিত-বেদনাক্লিষ্ট মলিনতায় বর্তমানে আশা জাগাতে হবে। চেতনা ও আত্মশক্তির আগুন জ্বালাতে হবে। নান্দনিকতার পরীক্ষা-নীরিক্ষার সময় তার কোথায়? তাকে এক হাতে করতে হয়েছে একশ হাতের কাজ। খ্রিষ্টান মিশনারিদের বিভ্রান্তি বিস্তারের মোকাবিলায় লিখতে ও বলতে হয়েছে। ঔপনিবেশিক বিভাজননীতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সাংস্কৃতিক জাগরণের বীজ বুনতে হয়েছে গ্রাম-শহরে। নিপীড়িত নারীদের জন্য সোচ্চার থাকতে হয়েছে। রাজনৈতিক রণমঞ্চে থাকতে হয়েছে সামনের সারিতে। কত দল আর সমিতিতে সক্রিয় থেকেছেন তিনি; কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি, কৃষক সমিতি—কত নাম । জমিদার ও মহাজনবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের করেন সংগঠিত । আবার অঝোরধারে লেখেন তখনকার পত্রিকা আল-এসলাম, ইসলাম প্রচারক, প্রবাসী প্রচারক, কোহিনূর, সোলতান, মোহাম্মদী, সওগাত, নবযুগ, নবনূর ইত্যাদিতে।
সাম্প্রদায়িক অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল কলকাতা থেকে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর অগ্রসেনানী। তার আনন্দমঠ (১৮৮২), দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), রাজসিংহ (১৮৮২), সীতারাম (১৮৮৮) প্রভৃতি উপন্যাস মুসলিমদের হীন এবং ঘৃণ্য ও বিনাশযোগ্য অবয়বে হাজির করছে। এর প্রতিবাদে সিরাজী লেখেন রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), ফিরোজা বেগম (১৯১৮) ও নূরুদ্দীন (১৯১৯) প্রভৃতি উপন্যাস। এসব সাহিত্যিক প্রচেষ্টা কেবলই সাহিত্যিক ছিল না। এতে ছিল ইনসাফ, জাতীয় চৈতন্য ও মুসলিম ঐতিহ্যরক্ষার দায়ভারও। সিরাজীর ভাষায়—‘একই দেশের অধিবাসী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব থাকা সর্বদা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাঙ্গালী ভ্রাতারা কাল্পনিক আর্যামীর গৌরব-গানে বিভোর হইয়া কাণ্ডজ্ঞানহীন অবস্থায় লেখনী পরিচালনায় দারুণ অসদ্ভাবের বীজ রোপণ করিতেছেন।... তাহাদের মোসলেম কুৎসাপূর্ণ জঘন্য উপন্যাসগুলির পরিবর্তন করিয়া সুমতির পরিচয় দিবেন... নতুবা তাহাদের চৈতন্য উৎপাদনের জন্য আবার ঐসলামিক তেজঃদীপ্ত অপরাজেয় বজ্রমুখ লেখনী ধারণ করিতে বাধ্য হইব।’
স্বদেশে যখন এমনতরো রণাঙ্গণ প্রতিদিন তাকে ব্যস্ত রাখছে, তখনো তিনি আন্তর্জাতিক। জামালুদ্দীন আফগানী (১৮৩৮-১৮৯৭), শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) ও মুহাম্মদ ইকবালের (১৮৭৬-১৯৩৮) চিন্তা ও প্যানইসলামি ভাবধারা তার চিত্তজয় করেছিল। এই ভূমিতে তাদের আন্তর্জাতিকতার প্রতিধ্বনি ছিল সিরাজীর কণ্ঠে।
বলকান যুদ্ধকালে (১৯১২-১৩) ডা. মোখতার আহমদ আনসারীর (১৮৮০-১৯৩৬) নেতৃত্বে গঠিত হলো ‘ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট’। সংগঠনটি বলকানে চিকিৎসকসহ ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল মিশন’ প্রেরণ করে। এই মিশনে সিরাজী তুরস্কে গেলেন। সেখানে ওসমানী স্বাস্থ্য দপ্তরের ইন্সপেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ শেষে ওসমানী সালতানাত তাকে ‘গাজী-এ-বলকান’ (১৯১৩) উপাধী দেয়। পুরস্কার হিসেবে তাকে দেওয়া হয় শাহী পোশাক, সোনার চাঁদ লাগানো তুর্কি টুপি এবং আরো বহু স্মারক। বলকান যুদ্ধে তার অমর কৃতিত্ব তুর্কি ভাষায় লিখিত আছে আজও ‘আংকারা মিউজিয়ামে’, যা আজও সুরক্ষিত। ১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনি মেডিকেল টিম গঠন করে তুরস্কে গেলেন আবারও।
ইংরেজ উপনিবেশ ছিল সুদান। সেখানকার মুক্তিকামী কবি মেহেদী আরবি ভাষায় আগুনের বৃষ্টি বইয়ে দিলেন ‘কাফিয়া’ লিখে। সিরাজী ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের ভোক্তা। কাফিয়ার সেই স্বাধীনতাকামী তীব্রতাকে তিনি হাজির করলেন বাংলায়। অনুবাদে এর নাম দিলেন ‘স্বাধীনতা বন্দনা’। এতে মেহেদীর সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে নিদ্রামগ্ন বাঙালি জাতিকে জাগাতে ও জ্বালাতে তিনি গাইলেন—
পতিত জাতির উদ্ধার হেতু
উড়াও আকাশে রক্তিম কেতু
জাগুক মাতুক ছুটুক দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।
জয় জয় জয় স্বাধীনতা।
বাঙালি মুসলমানদের নিস্তব্ধতা ভাঙানোর জন্য তিনি বিশ্বমুসলিমের মধ্যে ঐক্যসূত্র অন্বেষণে সচেষ্ট হয়েছেন। মিল্লাতচেতনার উজ্জীবন বিস্তার করেছে তার কাব্যভাষা—
এসো বজ্র, এসো অগ্নি, এসো বায়ু, এসো ঝড়,
জ্বলুক বিপ্লববহ্নি বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর।
সপ্ত সিন্ধু একেবারে হোক আজি উচ্ছ্বসিত,
বহুক উচ্চ-ঊর্মি ভাঙ্গি গিরি বন যত।
শত বজ্র ভীমনাদে গর্জুক অম্বর দেশে,
জাগুক মোসলেমগণ সর্বস্থানে সর্বদেশে। (মরক্কো সংকটে)
সংকটাপন্ন বিশ্ব তাকে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিকতায় কবলিত পৃথিবীর নতুন জীবন তিনি তালাশ করেছেন মুসলমানদের অভ্যুত্থানে। তার ভাষায়—
ইসলাম গৌরবের বিজয় কেতন
হে মোর আশার দীপ নব্য যুবগণ।
মোসলেমের অভ্যুত্থানে
ইসলামের জয়গানে
আবার লভুক বিশ্ব নতুন জীবন।
সেই অভ্যুত্থান জীবিতের অভিনয় করতে থাকা মৃতদের দিয়ে সম্ভব নয়। সেজন্য দরকার মহাপ্রাণের অভ্যুদয়। সিরাজীর ভাষায়—
একটিও যদি পাই মহাপ্রাণ
একটিও যদি পাই মুসলমান
তাহলে অচিরে মহা অভ্যুত্থান গাইব।
সিরাজীর সেই অভ্যুত্থান সামগ্রিক জীবনময়। সেই জাগরণ প্রতিটি দিক ও দিগন্তকে আলিঙ্গন করে। অবক্ষয়ের সকল ময়দানে তিনি সমস্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হন।
তিনি মুখোমুখি হন ধর্মবর্জিত জগৎচর্চার এবং জগৎচর্চাবর্জিত ধর্মের। বলেন, ‘মুসলমানদের বিশ্বসভ্যতায় স্থান নিতে হলে তাদের ডান হাতে কোরআন আর বাঁ হাতে বিজ্ঞান নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।’
নিরীহ-নিষ্প্রাণ ধর্ম তার কাছে ধর্ম নয়। ধর্ম দেবে শক্তি, বিক্রম, প্রাবল্য, আনবে প্রাণের কোলাহল। বলেন, ‘যেখানে শক্তি নাই, তেজ নাই, বিক্রম নাই, আধিপত্য নাই, সেখানে ধর্মও নাই।’
তিনি মুখোমুখি লড়েন পরাধীনতা ও মানসিক দারিদ্র্যের সঙ্গে। বলেন, ‘স্বাধীনতা লাভ করিতে না পারিলে মন কখনো সুস্থ ও সবল হইতে পারে না। জাতি স্বাধীন না হইলে তাহার চিন্তাশক্তিও স্বাধীন এবং বলবতী হইতে পারে না।’
নারীদের জ্ঞান ও কর্মের স্বীকৃত পরিসরকে যারা অস্বীকার করে, তিনি তাদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। বলেন, ‘যাহারা নারীকে পেছনে রাখিয়া অন্ধ অন্তঃপুরের বেষ্টনে বেষ্টিত রাখিয়া জাতীয় জাগরণের কল্যাণ কামনা করে, আমার বলিতে কুণ্ঠা নাই তাহারা মহামূর্খ’! তার মতে, ‘পুরুষ সামাজের দেহ, আর মাতৃজাতি সেই দেহের আত্মা।’
মাতৃভাষা চর্চায় উদাসীন মুসলিমদের প্রতি তার সতর্কবার্তা ছিল স্পষ্ট, উন্নত সাহিত্য সৃষ্টিতে তার আহ্বান ছিল উদাত্ত। বলেন, ‘যে জাতির ভাষা যত উন্নত, সে জাতির ভাষায় উৎকৃষ্ট গ্রন্থের সংখ্যা তত অধিক। পৃথিবীতে চিরকাল সেই জাতি সেই পরিমাণে উন্নতি লাভ করিয়াছে এবং করিতেছে।... মাতৃভাষা ব্যতীত কোনো জাতি উন্নতি লাভ করিতে পারে নাই।... ভ্রাতঃবঙ্গীয় মুসলমান! আর আলস্যে কাল কাটাইও না। বঙ্গভাষাকে হিন্দুর ভাষা মনে করিও না। যে ভাষায় তুমি মনে সুখ-দুঃখের কথা প্রকাশ কর, যে ভাষায় তুমি স্বপ্ন দেখ, যে ভাষায় তুমি মনোভাব ব্যক্ত করিয়া সমস্ত শান্তি এবং আরাম লাভ কর, তাহা নিজের মাতৃভাষা। জগতের সমস্ত ভাষা অপেক্ষা তাহার গৌরবের পরিমাণ নিতান্ত অল্প নহে।’
সিরাজী মুসলিম জাতির অতীত গরিমা নিয়ে লিখেছেন বিস্তর। তার অতীতচারিতা ছিল বর্তমানকে জাগানোর জন্য, অনাগত দিনগুলোকে রাঙানোর জন্য। ‘স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪)’-এর মতো মহাকাব্যিক আয়োজন, ‘বঙ্গ ও বিহার বিজয় (১৮৯৯)’-এর মতো উপন্যাস, কিংবা ‘সংগীত সঞ্জীবনী (১৯১৬)’, ‘প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬)’-এর মতো গীতিপ্রয়াসের সঙ্গে তিনি ঘটকালি করেছিলেন ‘আকাঙ্ক্ষা (১৯০৬)’, ‘উচ্ছ্বাস (১৯০৭)’, ‘উদ্বোধন (১৯০৭)’, ‘নব উদ্দীপনা (১৯০৭)’-এর। লেখনী ও জীবনসংগ্রামে তার কেন্দ্রীয় অন্বেষা ছিল আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা।
১৯৩১ সালে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন। কারাগারেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যে সিরাজী বলতেন, ‘আমি মৃত্যুর মাঝে চিরদিন খুঁজি নবজীবনের সন্ধান,’ তিনি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমরতাকে বরণ করলেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই।
তার মৃত্যুতে প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছিল পরম বন্ধুকে। প্রতিক্রিয়া শুধু উপমহাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না। আতাতুর্ক মোস্তফা কামাল পাশা (১৮৮১-১৯৩৮) তার শোকবাণীতে বলেন, ‘আমার পুরোনো বন্ধু সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী যে কেবল ভারতের গৌরব ছিলেন তা নয়, তিনি ইসলাম জগতের নেতা ছিলেন। তার মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বে এক বিখ্যাত ব্যক্তির শূন্যতা তৈরি হলো।’
সিরাজীর সাধনাস্রোত অচিরেই কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৯) সামুদ্রিক অভ্যুত্থানে নিজের উত্তরাধিকার প্রত্যক্ষ করল।

